প্রদীপ আচার্য
করোনা নিয়ে গুজব ছড়াবেন না। বাড়িতে থাকুন। ঘন ঘন হাত ধোন। সোশ্যাল সাইটের সব খবর বিশ্বাস করবেন না। গুজব ছড়ালে কিন্তু তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মনে থাকে যেন। মাস্ক নেই, গ্লাভস নেই একথা বলা উচিত হবে না। তাছাড়া সর্বদা স্বার্থপরের মতো ভাবলে হবে? সার্বিয়াকে গ্লাভস ও মাস্ক আমরাই দিয়েছি। একেই বলে পরার্থে বাঁচা। আমাদের ডাক্তাররা খানিকটা ত্যাগ স্বীকার করলেন তো কি হয়েছে ? দেশের নাম তো উজ্জ্বল হল। ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।
আমরা ঘরের আলো নিভিয়ে রাট ৯ টা ৯ মিনিটে ব্যালকনিতে মোমবাতি জ্বালাব। প্রদীপ জ্বালাব। মোবাইলের টর্চ জ্বালাব। কি যে মজা হবে এযেন অকাল দীপাবলী! কিরকম একটা পুজো পুজো ব্যাপার। আগেরবারও শাঁখ বাজিয়েছিলাম। ব্যালকনি ও ছাদ থেকে সেলেবরা থালা বাজিয়েছিল। বচ্চন কাকুরা এমন করেছিলেন আমি মনে করেছিলুম যাক বাবা এ যাত্রা বাঁচা গেল।শব্দের চোটে করোনা বোধহয় পগার পার! কিন্তু তারপরই লকডাউন। বেরসিকরা বলছেন আলো জ্বালিয়ে কাঁসি বাজিয়ে কিচ্ছু হবে না। গ্লাভস চাই , মাস্ক চাই। সেলিব্রেশন করার মতো কিছু হয়নি।
এই তো সেদিনও টিভিতে প্রচার ‘যাঁহা সোচ উঁহা শৌচালয়।’ শৌচালয় নির্মাণ করে তা ব্যবহার করতে বলা হত। যাদের এমন হাল তারা ঘন ঘন কি সাবান দিয়ে হাত ধুতে পারবে? এদেশের বহু লোকের থাকার মত ঘর নেই। রাতে তারা মাথা গুঁজতে ঘরে যান। এগুলো ঠিক ঘর নয়, বেশিরভাগই অত্যন্ত অস্বাস্থকর আশ্রয়। সে কারণেই সকাল হলেই তাঁরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। রাস্তা তাদের কাছে আরামদায়ক জায়গা। সেখানে আর কিছু না থাক আলো হাওয়া থাকে। বস্তির শিশুরা রাস্তায় খেলাধুলা করে বড় হয়। সাংঘাতিক ইমিউন ওদের। নো ডাস্ট এলার্জি। আরও বহু অসুখ ওদের নেই। একেই বলে অভিযোজন! এদেশে অগণিত মানুষ প্রবল জীবনী শক্তি নিয়ে রাস্তায় দিন কাটান। রাস্তায় তাদের সবকিছু। না খেতে পেয়ে মরা বেশি কষ্টের নাকি করোনা আক্রান্ত হয়ে? এখনও এমন কোন সার্ভে বোধহয় হয়নি।
আমরা ভারতীয়রা রাজার গল্প শুনে বড় হয়েছি। এই রাজা ব্যাপারটা থেকে আমরা বের হতে পারিনি। সে কারনে এত বড় একটা গণতান্ত্রিক দেশে থেকেও আমরা আর নাগরিক হতে পারলাম না। ১২০ কোটি ভারতবাসীর হাতে গোনা কিছু মানুষ হয়তো নাগরিক। বাকি আমাদের মত নাম পরিচয়হীন মানুষগুলো আসলে অভিশপ্ত প্রজা। বিশেষ রাজনৈতিক দলের ভোটব্যাঙ্ক। সে কারণেই তুচ্ছমূল্যে আমরা সহজেই বিক্রি হয়ে যাই। আমরা ওদের গিনিপিগ। সময়মত ওরা আমাদের ভিতর বিদ্বেষ ঢোকায়। তা করোনার থেকেও ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সাবান দিয়ে সানিটাইজার দিয়ে তা ঠেকানোর কোনও রাস্তা নেই। কোয়ারেন্টাইন , লকডাউন কোনও কিছু দিয়েই একে বাগে আনা যায় না। সংক্রামিত হয়ে গেলে একেবারে কাছের বন্ধুর কন্ঠস্বরও কেমন অচেনা ঠেকে। চোখের সামনে কতজনকে এমন সংক্রমণে আক্রান্ত হতে দেখলাম।
সংক্রামিত বিদ্বেষে কতবার দাঙ্গায় মরেছি তার হিসেবে নেই। এই কদিন আগেই দিল্লিতে যা হল,তা দেখে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। করোনার ভীতিপ্রদ মৃত্যু মিছিলের থেকে সেই সংখ্যা খুব কম নয়। দুঃখের বিষয় হল, আমরা যাদের জনপ্রতিনিধি মনে করি তারা অনেকেই বিদ্বেষ সংক্রমণে আক্রান্ত। তাদের অবিলম্বে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো উচিত। তা না হলে করোনা থেকে আপাতত বাঁচলেও গোটা দেশ বিদ্বেষে শেষ হয়ে যাবে।
করোনার এমন সময়েও নিজামুদ্দিন নিয়ে চর্চা অন্য মাত্রা পেয়েছে। সচেতনভাবেই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত বললাম না। সংক্রমণের দায় কেবল কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতায় আমার আপত্তি। বিদেশিরা প্রত্যেকেই বৈধ পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে নিজামুদ্দিনে এসেছিলেন। আগেই বাধা দেওয়া হলে তাঁরা ফিরে যেতেন। উড়ান বাতিল করা হলে তাদের আসার কোনও প্রশ্নই থাকত না। কিন্তু এখন করোনার থেকে বেশি চর্চা নিজামুদ্দিন নিয়ে। ভালোবাসাকে যারা লাভ জিহাদ নামক শব্দে বন্দি করেছে, নিজামুদ্দিন নিয়ে তারাই অধিক উৎসাহী সন্দেহ নেই।
কেউ বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করলে, যেখান থেকে সে বিষ কিনেছে এরা সেই দোকানদারের নাম-পদবি জিজ্ঞাসা করে তার ধর্মের হদিশ পেতে চায়। যদি দোকানদারের ট্রিম না করা রবীন্দ্রনাথ মার্ক লম্বা দাড়ি থাকে তাহলে তো সব দায় দোকানদারের। যে ইঁদুর মারা বিষ খেয়েছে তার নয়। অসুস্থ লোকটি কিভাবে সুস্থ হবে সে ভাবনা তাদের নয়। এদের দাবি দোকানদারকে সাজা দিতে হবে। লোকটি মারা গেলে সেই সাজার দাবি জোরালো করা যায়। এর দায় বিশেষ সম্প্রদায়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায়। দেশনায়করা যেভাবে করোনা আক্রান্তদের বাধ্যতামুলক গৃহবন্দীর নির্দেশ দিচ্ছেন, প্রশাসন যেমন কঠোর হয়েছে, বিদ্বেষ সংক্রমণে রুখতে তেমন দাওয়াই দেশকে বাঁচাতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রনায়করাই যদি নানা কায়দায় বিদ্বেষের চাষ করেন, পুলিশ যদি দাঙ্গাবাজদের মদত করে করে তাহলে কোভিড ১৯ এর হাত থেকে রক্ষা পেলেও রাজনৈতিক মদতপুষ্ট বিদ্বেষের হাত থেকে রক্ষা পাবে না।