কলকাতা: লোকসভা ভোটের মুখে রাজ্যের একাধিক পুলিশ আধিকারিকের বদলিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযোগ করে শনিবার নির্বাচন কমিশনের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সেই অভিযোগকে খণ্ডন করে রবিবার পাল্টা চিঠি দিল কমিশন।
রবিবার নির্বাচন কমিশনের তরফে জানানো হয়েছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে যে অভিযোগ করেছেন, সেগুলি কোনওটাই ঠিক নয়। কোনও রকমের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেনি কমিশন। কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রভাবেও এই সিদ্ধান্ত নেয়নি তারা। সার্বিক রিপোর্ট, অর্থাৎ বিশেষ পুলিশ পর্যবেক্ষকের দেওয়া রিপোর্ট এবং কমিশনের নিজস্ব রিপোর্টের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কমিশনের তরফে আরও জানানো হয়েছে, অধিকারের সীমার মধ্যে থেকেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। সংবিধানের ২৮এ ধারায় জনপ্রতিনিধিত্বমূলক আইন অনুযায়ী সরানো হয়েছে ওই চার পুলিশ কর্তাকে। ১৯৯৪ সালে কেরল হাইকোর্টের নির্দেশ উদ্ধৃত করে কমিশন জানায়, সংবিধানের ৩২৪ (৬), ১৯৫০ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১৩ সিসি এবং ১৯৫১ সালের ২৮-এ ধারা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের হাতে বিশেষ ক্ষমতা রয়েছে। যার আওতায়, নির্বাচনী আচরণ বিধি চালু হয়ে যাওয়ার পর, কমিশন চাইলে কোনও অফিসারকে নতুন জায়গার দায়িত্বে বসাতে পারে। আবার চাইলে তাঁকে বদলিও করতে পারে অন্যত্র।
বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশেই বাংলার পুলিশ প্রশাসনিক ব্যবস্থায় রদবদল ঘটানো হয়েছে বলেও গতকাল অভিযোগ তোলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন জানায়, গত ৩১ জানুয়ারি এবং ১ ফেব্রুয়ারি, দু’দিন ধরে কলকাতায় রাজ্যের নির্বাচনী প্রস্তুতি এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করে দেখে নির্বাচন কমিশন। মুখ্যসচিব, ডিজি-সহ প্রশাসনিক কর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা হয়। বিরোধী দলগুলির অভিযোগ খতিয়ে দেখে মার্চের মাঝামাঝিও একবার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখেন ডেপুটি নির্বাচন কমিশনার। আনা হয় বিশেষ পর্যবেক্ষকও। তবে শুধুমাত্র বাংলাই নয়, নির্বাচনের আগে ঝাড়খন্ড, মিজোরাম, ত্রিপুরা, অরুণাচলপ্রদেশ এবং তেলঙ্গানার মতো রাজ্যেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাই বেছে বেছে শুধু বাংলাকেই নিশানা করা হয়েছে, এমন নয়। ডেপুটি নির্বাচন কমিশনারের রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই ওই চার অফিসারকে বদলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে, গত শুক্রবার রাতে কলকাতা এবং বিধাননগরের পুলিশ কমিশনার-সহ চারজন আইপিএস অফিসারকে বদলির নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন। তাঁদের জায়গায় আনা হয় নতুন অফিসারদের। অনুজ শর্মার জায়গায় কলকাতা পুলিশের নয়া কমিশনার হিসাবে নিযুক্ত করা হয় রাজেশ কুমারকে। আগে যিনি দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এডিজি ছিলেন। অনুজ শর্মাকে নিয়োগ করা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়রাজ্য পুলিশের এ়়ডিজি (অপারেশনস) পদে। বিধাননগরের সিপি জ্ঞানবন্ত সিংহকে সরিয়ে সেই জায়গায় আনা হয় রাজ্য পুলিশের এডিজি (অপারেশনস) নটরাজন রমেশ বাবুকে। জ্ঞানবন্ত সিংহকে অর্থনৈতিক অপরাধ সংক্রান্ত শাখার অধিকর্তার নিয়োগ করা হয়। অর্থনৈতিক অপরাধ সংক্রান্ত শাখার অধিকর্তা পদ থেকে সরিয়ে এনে জয়ন্তকুমার বসুকেদেওয়া হয় এডি়জি এস্টাবলিশমেন্টের দায়িত্ব।
রাত কাটতেই শনিবার কমিশনকে কড়া চিঠি লিখে অসন্তোষ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি সরাসরি অভিযোগ করেন, কমিশন পক্ষপাত করছে। ‘রাজনৈতিক প্রভু’ তথা বিজেপি-র কথায় বদলি করা হয়েছে দক্ষ পুলিশ অফিসারদের। এবং যাঁদের কমিশনার করা হয়েছে, তাঁদের সেই যোগ্যতা যে নেই সেই দাবিও করেন তিনি। চিঠিতে মমতা লেখেন, “কমিশনের এই সিদ্ধান্ত খামখেয়ালি শুধু না, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও পক্ষপাতদুষ্ট। বিজেপি-র পক্ষ নিয়ে যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।” তিনি আরও অভিযোগ করেন, “ক’দিন আগে সাংবাদিক বৈঠক করে বিজেপি নেতারা বলেছিলেন রাজ্যের সিনিয়র পুলিশ অফিসারদের খুব শিগগির বদলি করে দেবে নির্বাচন কমিশন। তার পর শুক্রবার একটি টিভি শো-তে প্রধানমন্ত্রী তথা বিজেপি প্রার্থী বলেছেন, বাংলায় আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতি ভাল নয়, সে জন্যই সেখানে সাত দফায় ভোটের আদেশ দেওয়া হয়েছে।” তৃণমূলনেত্রীর অভিযোগ তার পর পরই, বাংলার চার পুলিশ অফিসারকে বদলির নির্দেশ দিয়েছে কমিশন। তাঁর কথায়, এই সব ঘটনা পরম্পরা থেকে কমিশনের কাজকর্ম নিয়ে ঘোর সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। তারা কি সাংবিধানিক নিয়ম মেনে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট করাতে চাইছে, নাকি বিজেপি-কে খুশি করে চলতে চাইছে।