বিশেষ প্রতিবেদন
বাংলার নেতাদের ওপর তেমন ভরসা করতে পারছেন না শাহ-মোদী। বঙ্গ বিজেপিকে দেখে মনে হচ্ছে যেন মোহনবাগান, কিংবা ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। যেখানে বিদেশী ফুটবলারদের রমরমা। এখন বাংলার যেসব বিজেপিনেতা রয়েছে, তারা আসলে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশি চিন্তিত। কে কার কুর্সিতে কখন বসে পড়েন সেই চিন্তায় তারা আকুল। আসলে ভাষা এখানে একটা বড় ফ্যাক্টর। ভাষার ভিতর দিয়ে সংস্কৃতি ঢোকে। তাই সেই অর্থে বাঙালি নেতাদের সেইভাবে বিশ্বাস করতে পারছেনা কেন্দ্রীয় বিজেপি। সে কারণে দিলীপ ঘোষের মত নেতা থাকার পরও বিজেপি ধনকরের ওপর বেশি নির্ভর করেছে বরাবর।
সুনীল দেওধর, দুষ্মন্ত গৌতম, বিনোদ তাওড়ে, হরিশ দ্বিবেদী এবং বিনোদ সোনকর। বাংলার বাইরে থেকে এই পাঁচ নেতাকে এনে গঙ্গাপাড়ের নীলবাড়ি দখলে নামছে বিজেপি। এঁরা সকলেই নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের ‘আস্থাভাজন’। অমিতের নির্দেশেই বাংলায় ভোটের রণনীতি তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই পাঁচ নেতার উপর। পশ্চিমবঙ্গকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে একেকটি এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে পাঁচ নেতার প্রত্যেককে। ঘটনাচক্রে, এঁরা প্রত্যেকেই অবাঙালি।
এ বিষয়ে তৃণমূল বঙ্গ বিজেপিকে তীব্র কটাক্ষ করেছে— ‘‘বাংলার লড়াইয়ে বাঙালির উপর আস্থা রাখতে পারছে না বিজেপি!’’ বুধবারই তৃণমূলের মুখপাত্র তথা সাংসদ সুখেন্দুশেখর রায় ওই পাঁচ নেতাকে ‘বহিরাগত’ বলে অভিহিত করেছেন। বুধবারই ওই পাঁচ নেতার মধ্যে চারজন নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকায় বৈঠক শুরু করে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: ‘নিজে হস্তক্ষেপ করে নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য সামনে আনুন’, এবার মোদীকে চাপ মমতার
মোদ্দা কথা বিজেপি বুঝে উন্নয়নের ভেঁপু বাজিয়ে কাজ হবে না। অন্য খেলা লাগবে। সেই খেলা এ যাবৎ বিজেপিকেই মানিয়েছে। বিজেপি মনুবাদী দল। তা কারও অজানা নয়। এখানে দলিতরা আজও মর্যাদা পায়না। কিন্তু মোদী জমানায় তাদের অন্যভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। তাদের বোঝানো হয়েছে, ব্রাহ্মণ কিংবা উচ্চবর্ণ নয়,তাদের শত্রু আসলে মুসলিম। দীর্ঘদিন যারা উচ্চবর্ণের কাছে মর্যাদা পেতে চেয়েছে এ হেন খবরে তারা অনেকেই আহ্লাদিত। তাদের দিয়েই বিষ উগড়ানোর কাজটা করতে চাইছে বিজেপি। এতে সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না।
সে কারণে বিজেপি তফসিলি ও আদিবাসী ও সীমান্ত রাজ্যের দেহাতি ভোটকে পাখির চোখ করছে। তাদের দিয়েই বাংলার এতদিনের শালীন সংস্কৃতিতে আঁচড় কাটতে চাইছে। এই বাংলার সাম্প্রদায়িকতা বিজেপি আমদানি করছে, একথা বললে ষোলো আনা মিথ্যা হবে। কিন্তু বাংলায় যে সাম্প্রদায়িকতা ছিল, তাকে আড়াল করে রাখা হত। সাম্প্রদায়িক মানুষ জানতেন, এটা খারাপ ভাবনা। তাই তা রাষ্ট্র করার দরকার নেই। যা আছে মনে থাক। বিজেপি সেটা নষ্ট করে দিতে চাইছে। সে কারণে সহিষ্ণুতার প্রতীক রামের নামে ‘জয় শ্রী রাম’ হুঙ্কার ছেড়ে একটা সম্প্রদায়কে তারা ভয় পাওয়াতে চাইছে।
এই ভয় পাওয়ানোর কাজটা কি দিলীপ ঘোষরা করতে পারতেন না ? তাহলে তাদের ওপর আস্থা রাখা হচ্ছে না কেন? আসলে বিজেপি এখন ‘টুম্যান’ পার্টি । সংঘ তার কাজ করে যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু বিজেপি চলছে মূলত শাহ ও মোদির লবিতে। তাদের লবির লোকেরাই বাংলায় ভোট গেমে নামছে। বিজেপি হিন্দু সংস্কৃতি লালন করে, তারা হিন্দুত্ব পার্টি, এই ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল। সনাতন ধর্মের সঙ্গে এদের কোনও সম্পর্ক নেই। এরা অর্থনৈতিক ভাবে একটি পুঁজিপতির দালালি করা পার্টি। যেমন আর পাঁচটা ডানপন্থী দল হয়। ফলে কংগ্রেসের সঙ্গে সেই অর্থে তার আর্থিক নীতিতে বিশেষ ফারাক থাকার কথা নয়। কিন্তু বিজেপির গুরু আরএসএস ঠিক নাৎসিদের মত ‘সুপ্রিমেসিতে’ বিশ্বাস করে। সে কারণে তারা হিন্দু ছাড়া আর কাউকে বড় চোখে দেখতে চায়না।
হিন্দুদের মধ্যেও তারা আসলে ব্রাহ্মণ এবং উচ্চবর্ণকে নেতৃত্বের জায়গা ছাড়তে চায়। কিন্তু তাতে গোটা ভারত জয় সম্ভব হবে না। সে কারণেই তারা এতদিন পিছিয়ে ছিল। ফলে তারা রণনীতি বদলায়। ঠিক করে দলিতদের একটা অংশকে পাশে নিয়ে সংখালগুদের আতঙ্কে রাখার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। মোদী জামানায় তারা প্রথম এই কাজটি সফলভাবে করতে সক্ষম হল।
একথা অস্বীকারের উপায় নেই যে বাংলার সংস্কৃতি গোবলয়ের সংস্কৃতি থেকে আজও উন্নত। বহু বাঙালি বিজেপি সমর্থক আজও প্রকাশ্যে ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দিতে ইতস্তত করেন। তার মানে এই নয় যে তারা ভগবান রামচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নন। তার কারণ হল তারা বাঙালি। এই স্লোগানের আড়ালে একটা সম্প্রদায়কে ভয় পাওয়ানোর ব্যাপারটা তারা হজম করতে পারে না। হয়তো তাদের মধ্যেও নিজেদের উঁচু মনে করার প্রবণতা রয়েছে, কিন্তু তারপর প্রকাশ্যে সম্প্রীতির কথা শুনতে তারা অধিকাংশই ভালোবাসে। সাধারণ বাঙালি হিন্দু এবং বাঙালি মুসলমানের বাঙালি হিসাবে যে গর্বের অনুভূতি রয়েছে, তা কাশ্মীরি ছাড়া আর কারও মধ্যে বোধ করি নেই। সেখানে রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ একাকার হয়ে আছে। সেখানে ধর্ম নেই। বাঙালি আছে। সেটা অমিত শাহরা বুঝেছে।
তাই নিয়ে আসা হয়েছে সুনীল দেওধরকে। এক সময়ের সঙ্ঘের প্রচারক সুনীল দেওয়ধর এখন বিজেপি-র সর্বভারতীয় সম্পাদক।বিজেপি-তে আসার পরে গুজরাতের দাহোড় জেলার দায়িত্বে ছিলেন। তখন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ২০১৩ সালে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে ছিলেন দক্ষিণ দিল্লির দায়িত্বে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে মোদীর কেন্দ্র বারাণসীর দায়িত্ব সামলান সুনীল।দেওধর ভাল বাংলাও জানেন। বিধানসভা ভোটে মেদিনীপুর জোনের দায়িত্বে। এই জোনে রয়েছে দুই মেদিনীপুর ছাড়াও হাওড়া ও হুগলি জেলার আসনগুলি।
বিজেপি-র অন্যতম সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দুষ্মন্তগৌতম হরিয়ানা থেকে রাজ্যসভার সাংসদ। দিল্লিতেই জন্ম। দিল্লিতেই বড় হওয়া। র্ঘসময় বিজেপি-র তফসিলি মোর্চার দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৯ সালে বিজেপি গোটা দেশে যে ‘সদস্যতা অভিযান’ চালিয়েছিল, তার গুরুভার ন্যস্ত ছিল দুষ্মন্তর উপরে। বাংলার ভোটে দিল্লির দুষ্মন্ত সামলাবেন কলকাতা জোন। এই জোনে কলকাতা ছাড়া রয়েছে দুই ২৪ পরগনাও।নীলবাড়ি দখলের লড়াইয়ে বিনোদের দায়িত্বে বর্ধমান জোন। দুই বর্ধমান ছাড়াও এই জোনে রয়েছে মুর্শিদাবাদ, নদিয়া এবং বীরভূম জেলা।
উত্তরপ্রদেশের হরিশ দ্বিবেদী বর্তমানে বিজেপি-র সর্বভারতীয় সম্পাদক। ২০১৪ এবং ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে পর পর দু’বার জিতেছেন উত্তরপ্রদেশের বস্তি আসন থেকে। বাংলায় উত্তরবঙ্গের দায়িত্বে হরিশ। এই জোনে রয়েছে উত্তরবঙ্গের সব ক’টি জেলা।
সদ্য ত্রিপুরার পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পেয়েছেন বিনোদ সোনকর। ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে পর পর দু’বার লোকসভা নির্বাচনে জয়ী বিনোদের জন্ম থেকে রাজনীতি সবই উত্তরপ্রদেশে। বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে বিনোদের দায়িত্বে জঙ্গলমহল জোন। এই জোনে রয়েছে ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়া জেলা।
মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী বিনোদ তাওড়ে এখন বিজেপি-র সর্বভারতীয় সম্পাদক। একই সঙ্গে তিনি হরিয়ানার পর্যবেক্ষকের দায়িত্বে। মহারাষ্ট্র বিধানসভায় এক সময় বিরোধী দলনেতাও ছিলেন বিনোদ। নীলবাড়ি দখলের লড়াইয়ে বিনোদের দায়িত্বে বর্ধমান জোন। দুই বর্ধমান ছাড়াও এই জোনে রয়েছে মুর্শিদাবাদ, নদিয়া এবং বীরভূম জেলা।
আরও পড়ুন: ধর্ম ও জাতপাত রাজনীতি এদেশের ডিএনএ-তে, তাহলে মিমে আপত্তি কেন