Poet Nazrul taught Bengalis to straighten their spines

বাঙালিকে শিরদাঁড়া সোজা করতে চলতে শিখিয়েছিলেন কবি নজরুল

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on telegram
Share on whatsapp
Share on email
Share on reddit
Share on pinterest

বিপ্লবী মানবতার কবি নজরুল উনিশশ বিশের দশকে বিদ্রোহের কবিতা লিখে বাঙালির চেতনায় ঝড় তুলেছিলেন। সে বিদ্রোহ ছিল অন্যায়, অসত্য, শোষণ, বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতায় বিরুদ্ধে; কলুষিত পচা সনাতন মিথ্যার বিরুদ্ধে; সব ধরনের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। সে বিদ্রোহ ছিল বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। অন্যদিকে তিনি চমৎকার প্রেমের কবিতা লিখেছিলেন, কারো কারো মতে, তাঁর সবচেয়ে সেরা কবিতাগুলো হচ্ছে প্রেমের কবিতা। প্রেমের সেসব কবিতা জীবনকে সার্থক ও ঋদ্ধ করতে চায়; পূর্ণ ও আনন্দময় করতে চায়। অন্যদিকে বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতো কিছু কবিতায় তিনি প্রেম ও বিদ্রোহের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন, যেমনটি প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর নিজের জীবনে।

নজরুলের কবিতা কুশলতার সঙ্গে রচিত। তাতে আছে পাঠকের মনকে ছুঁয়ে যাওয়ার অসাধারণ ক্ষমতা। তাঁর কবিতার ভাষা ও ভাববস্তুতে রয়েছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেওয়ার পরিসর; আছে শক্তিশালী ও নিরন্তর হৃদয়-সংবেদী আবেদন। নজরুলের কবিতার সর্বকালীন আবেদনের মূলে রয়েছে প্রগাঢ় মানবতাবাদ। তা মূর্ত হয়েছে সর্বস্তরের মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতিতে, দুঃখী মানুষের অসহায়তার আন্তরিক উপলব্ধিতে এবং শোষিত-নির্যাতিত মানুষের জন্য প্রবল সহমর্মিতা ও সহৃদয়তায়।

দুর্বল, ভীরু মানুষকে নজরুল সাহস জুগিয়েছেন, সকল বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার উদ্দীপনা জাগিয়েছেন। রাজনৈতিক সংশ্নিষ্টতার মধ্যে মুক্তির পথ খুঁজেছেন; ইতিহাস খুঁজে প্রগতির দীক্ষা নিয়েছেন। বিখ্যাত ‘কামাল পাশা’ কবিতায় নজরুলের প্রখর ইতিহাস-চেতনার পরিচয় মেলে। ভারতে মওলানা মোহাম্মদ আলী ও মওলানা শওকত আলীর নেতৃত্বে তুরস্কে মধ্যযুগীয় সামন্ত শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য যে খেলাফত আন্দোলন হয়েছিল তাতে নজরুলের আস্থা ছিল না। বরং মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে তুরস্কে সালতানাতের অবসান ঘটিয়ে যে নব্য তুর্কি আন্দোলন হয়েছিল তাতে তাঁর দৃঢ় সমর্থন ছিল। এর কারণ, কামাল পাশা তুরস্ককে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করেছিলেন। তুরস্কের সমাজ জীবন থেকে মৌলবাদ ও পর্দাপ্রথা দূর করার কামাল পাশার সাফল্য নজরুলকে যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করেছিল। তিনি ধর্মান্ধতা, রক্ষণশীলতা, কুসংস্কার ও আচার-সর্বস্বতার কবল থেকে তুরস্কের মতো ভারত ও বাংলার জনগণের মুক্তি চেয়েছিলেন।

নজরুল ছিলেন মনে-প্রাণে অসাম্প্রদায়িক। তিনি তাই যোগ দিয়েছিলেন ভারতের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের সম্মিলিত আন্দোলনে। কবিতা ও গানে অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমুন্নত করেছেন বার বার। ‘পুতুলের বিয়ে’ নাটিকায় সন্নিবেশিত তাঁর গানে তিনি লিখেছিলেন, ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি ফুল – হিন্দু-মুসলমান।’ ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতায় লিখেছেন, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।’ শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ সম্প্রদায় নামে রাজনৈতিক দল গঠনেও নজরুল সক্রিয় ভূমিকায় নেমেছিলেন। সারা বাংলার বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে যোগ দিয়েছিলেন।

রাজনৈতিক বিবেচনা থেকেই তিনি প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে সাম্যবাদী আদর্শে প্রথম শ্রেণি-সচেতন সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। পত্রিকার নাম ছিল ‘লাঙল’। এই পত্রিকার পাতায়ই প্রথম প্রকাশিত হয় শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দলের ঘোষণাপত্র, যেখানে প্রথম উত্থাপিত হয়েছিল ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি।

আরও পড়ুন : ‘স্বপ্নের নীলাভ সাঁকো বেয়ে’ চলে গেলেন পরপারে…আজ কবি শামসুর রহমানের প্রয়াণদিবস

নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম এখন অগ্রসরমান সমকালে সে সংগ্রামেও ছিল নজরুলের অকুণ্ঠ সমর্থন। বিখ্যাত ‘নারী’ কবিতায় তিনি নারীকে পুরুষের সমমর্যাদার অভিষিক্ত করেছিলেন। তাঁর নিজের প্রথম রেকর্ড ছিল বিখ্যাত ‘নারী’ কবিতার স্বকণ্ঠ আবৃত্তি। ‘বীরাঙ্গনা’ কবিতায় তিনি নারীর অধিকার ও মর্যাদাকে সম্মানের সঙ্গে সমুন্নত করেছেন। ‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’ গানে মাতা, কন্যা, বধূ, জায়া ও ভগ্নি- সব রকমের সম্পর্কের নারীকে মুক্তির সংগ্রামে উদ্দীপ্ত করেছিলেন।

একই নজরুলের মধ্যে আমরা নানা নজরুলকে পাই। যে-কেউ তার নিজের মতো করে নজরুলকে খুঁজে নিতে পারেন। নজরুলের কবিতা ও গানের গভীর রয়েছে প্রবল দেশপ্রেম। তাতে রয়েছে উদ্দীপনা ও সাহস জোগানের শক্তি। আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁর কবিতা ও গান হয়েছে বাঙালির সহায়। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্যাম্পে ক্যাম্পে নজরুলের কবিতা ও গান হয়েছিল আমাদের মরণজয়ী প্রণোদনা।নজরুলের কবিতা ও গানের ভাববস্তুর বিচিত্রতা বাংলা কবিতাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে চলেছে।

নজরুল ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক চারণ কবি। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালির জাতীয় জাগরণের তিনি ছিলেন অন্যতম অগ্রপথিক। বাঙালির মানস চেতনায় তিনি এনেছিলেন উদ্দীপনাময় নবজাগরণের বাণী। সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ-বিরোধী জাগরণের উত্তাল সময়ে তিনি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল বাঙালিকে উজ্জীবিত করেছিলেন জাতীয় চেতনায়।

সকল প্রতিকূলতা ও অন্ধকারময়তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নজরুল আমাদের আশার আলো, আস্থার ভিত্তি, সাহসী ঠিকানা।ভিন্ন প্রসঙ্গে নজরুল লিখে গেছেন ‘আমি চিরতর দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেবো না ভুলিতে।’ এ কথা বহুলাংশে প্রাসঙ্গিক। সত্যিই বাঙালি নজরুলকে কখনো ভুলতে পারবে না।অসাধারণ সাহিত্যকৃতির জন্য কবি নজরুল আমাদের জীবন ও সাহিত্যে চিরজীবী হয়ে বেঁচে থাকবেন। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, বাংলা ভাষা থাকবে, ততদিন তিনি প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবেন।

আরও পড়ুন : Humayun Ahmed: জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের সেরা ৫ উপন্যাস

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on telegram
Share on whatsapp
Share on email
Share on reddit
Share on pinterest