বিধানসভা ভোটের আবহে সরগরম রাজ্য রাজনীতি, আর এই উত্তপ্ত পরিবেশেই ঐক্যের গান নিয়ে হাজির বাংলার নবীন-প্রবীন বুদ্ধিজীবীরা। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে টলিউড। কেউ গিয়েছেন গেরুয়া শিবিরে। কেউ বা এখনও সবুজের দলে। রং বদলের এই মরসুমে বেরিয়ে এল আরও এক শিবিরের স্বর। ‘নিজেদের মতে, নিজেদের গান’ বাঁধলেন শিল্পীরা। কোনও দলেই নেই যাঁরা, এই গান তাঁদের।
‘শিব ঠাকুরের আপন দেশে, আইন-কানুন সর্বনেশে’- সুকুমার রায়ের একুশের আইনের এই লাইন দিয়েই শুরু টলিউডের বুদ্ধিজীবীদের ‘নিজেদের মতে , নিজেদের গান’।গানের প্রতিটি অক্ষরে ঝরে পড়েছে প্রতিবাদ। প্রতিবাদ ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে, প্রতিবাদ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে, তবে এক সুরে সুর মিলিয়ে তাঁরা বলেছেন- ‘আমি অন্য কোথাও যাবো না, আমি এই দেশেই থাকব’।
২০১৯ সালে রামলীলা ময়দান থেকে শুরু হওয়া এক মিছিলে হাঁটার পরে অনির্বাণ ভট্টাচার্যের কলমে উঠে এসেছিল এই গান। সঙ্গে ছিলেন ঋদ্ধি সেন এবং ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়। তখনই এই ভিডিয়ো তৈরির কথা ভেবেছিলেন তাঁরা। এই কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেছেন কৌশিক সেন, রেশমী সেন, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, অনুপম রায়, রূপঙ্কর বাগচী, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, চন্দন সেন, রাহুল চট্টোপাধ্যায়, দেবলীনা দত্ত, সুমন মুখোপাধ্যায়ের মতো একাধিক তারকা। সিটিজেন ইউনাইটেডে-এর ইউটিউব প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পেয়েছে এই গান। যার ভিউ সংখ্যা এক লাখ।
আরও পড়ুন: ৬৭তম জাতীয় পুরস্কার: সেরা বাংলা ছবি ‘গুমনামী’, চিত্রনাট্যে সেরা কৌশিক-সৃজিত
মূলত ঋদ্ধি, সুরঙ্গনা এবং ঋতব্রতর উদ্যোগে সময় বার করে একসঙ্গে এসেছেন সকলে। পরিকল্পনা ও প্রতিস্থাপনের দায়িত্ব অনেকটাই সামলেছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। করোনা অতিমারির ভয় কাটিয়ে এই প্রচেষ্টাকে সফল করতে এগিয়ে এসেছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, অরুণ মুখোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তীর মতো প্রবীণ অভিনেতাও। দেশের বেকারত্ব, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন-জাতীয় নাগরিকপঞ্জি, নারী নিরাপত্তা, ধর্মের রাজনীতির মতো একাধিক সমস্যা তুলে ধরতে নবীনদের সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন তাঁরা। প্রশ্ন তুলেছেন আরও বহু সঙ্কট নিয়ে। ঋদ্ধির বক্তব্য, নির্বাচনের আগে বাংলার মানুষের মনে প্রশ্ন জাগাতেই তৈরি করা হয়েছে এই ভিডিয়ো। তিনি বলেন, “এই গানটি তৈরির পরিকল্পনা ছিল বহু দিন ধরেই। বাংলায় যাতে এই ফ্যাসিবাদী সরকার না আসতে পারে, তার জন্যই এই চেষ্টা।’’
ছেলের সঙ্গে সুর মেলালেন কৌশিক সেন। তুললেন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন-জাতীয় নাগরিকপঞ্জির প্রসঙ্গ। উত্তরপ্রদেশের ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের খতিয়ানও উঠে এল তাঁর কথায়। কৌশিক বললেন, “প্রাথমিক ভাবে বাংলায় বিজেপি-কে আটকানোটাই উদ্দেশ্য। তবে পশ্চিমবঙ্গে আজ যদি বিজেপি সরকার নাও আসে, কেন্দ্রে কিন্তু এই সরকারই থাকবে। তাই আমাদের লড়াইটাও জারি থাকবে।”
অভিনেত্রী-সংগীতশিল্পী সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায় নবীন-প্রবীণ শিল্পীদের এই মেলবন্ধন নিয়ে জানান, ‘বেসিক্যালি বয়সটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, সম মানসিকতার মানুষরা একজোট হয়েছেন একটা বক্তব্য বলবার জন্য, সেটা বেশি জরুরি। আমরা সত্যি খুব ভাগ্যবান সে সকলে রাজি হয়েছেন, এটা উপলদ্ধি করেছেন এই মুহূর্তে মানুষের কাছে এই বার্তাটা পৌঁছে দেওয়াটা জরুরি’।
‘‘মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার যে, ইন্ডাস্ট্রির কয়েক জন এখনও কোনও রাজনৈতিক দলের ধ্বজাধারীতে পরিণত হননি,’’ জানিয়েছেন ঋতব্রত। তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা এখন বলছেন মানুষের কাজ করতে রাজনীতিতে এসেছেন, লকডাউনে দুস্থ শিল্পীদের জন্য তাঁদের কাছে বারবার সাহায্য চেয়েও খালি হাতে ফিরতে হয়েছিল। তখন কোথায় ছিলেন তাঁরা?” নিজেদের রাজনৈতিক মতামতের কারণে যদি কাজ না পান, তা নিয়ে ভয় পেতে রাজি নন তিনি। একমত অনুপমও। তাঁর কথায়, সকলেরই নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করার অধিকার রয়েছে। গায়কের বক্তব্য, “কে কী ভাবল, সব দেখতে গেলে কাজটাই করা যাবে না। আমরা যা মনে করি, সেটাই শুধুমাত্র তুলে ধরেছি এই গানের মাধ্যমে।”
ভারত বহুত্ববাদের দেশ, সর্বধর্ম সমন্বয়ের দেশ। ‘নানা জাতি,নানা ভাষা, নানা পরিধান’-এর দেশ। গানের প্রতিটি লাইনে, ভিডিয়োর প্রতিটি ফ্রেমে বার্তা ‘ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক’। মোদী-তন্ত্রের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে বাংলার শিল্পীরা বললেন- ‘তুমি পুরাণকে বলো ইতিহাস, ইতিহাসকে বলো পুরানো… তোমার ভক্তিতে দাগ রক্তের তুমি কাউকেই ভালবাসো না… তুমি বেসাতি করতে এসেছ, দেশপ্রেমের কিছুই জানো না’।
আরও পড়ুন: করোনার কবলে বলিউড তারকা আমির খান, ‘লাল সিংহ চড্ডা’-র শ্যুটে পড়ল বিরতি