সংসার সীমান্ত ছেড়ে তিন ভুবনের পারে, ফিরে দেখা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত অনবদ্য চলচ্চিত্রগুলি

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on telegram
Share on whatsapp
Share on email
Share on reddit
Share on pinterest

চিরনিদ্রায় গেলেন বাংলার প্রবাদপ্রতিম শিল্পী। পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে বড় পর্দায় তাঁর আবির্ভাব। ১৯৫৯ থেকে ২০২০, হাসপাতালে অসুস্থতা নিয়ে ভর্তি হওয়ার আগে পর্যন্ত করোনাকে ভয় না পেয়ে নিজের কাজের জগতে ফিরে গিয়েছিলেন। ছয় দশক ব্যপ্ত তাঁর ফিল্মি কেরিয়ার। বাংলা চলচ্চিত্রকে তিনি পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের দরবারে। রোম্যান্টিক হিরো থেকে ভিলেন কিংবা ট্র্যাজিক নায়ক হয়ে উঠা- সব চরিত্রেই সিদ্ধহস্ত সৌমিত্র। বাঙালির প্রাণের অপু, পছন্দের ফেলুদা, আদরের খিদ্দা-সব ভূমিকাতেই তিনি অনন্য।

অপুর সংসার: এই ছবির সঙ্গেই সৌমিত্রর পথচলা শুরু। সত্যজিত্ রায়ের জহুরির চোখ ভুল করেনি অপুকে খুঁজে নিতে। বিভূতিভূষণের কল্পনার অপুর চরিত্রে প্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন সৌমিত্র। অপুর জীবনের টানাপোড়েনের আখ্যান জীবন্ত হয়ে উঠেছিল সৌমিত্রর ম্যাজিক্যাল পারফরম্যান্সে।

চারুলতা: ত্যজিৎ রায় পরিচালিত একটি চলচ্চিত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় গল্প নষ্টনীড় অবলম্বনে এর চিত্রনাট্য রচিত হয়েছে। অমলের ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অনবদ্য। প্রাণোচ্ছ্বল, সাহিত্যপ্রেমী, সঙ্গীতপ্রেমী অমলের ভূমিকায় নিজেকে ফুটিয়ে তোলেন। পরিচালক সত্যজিত্ রায় ও সৌমিত্র জুটির অন্যতম সেরা ছবি চারুলতা।

ক্ষুধিত পাষাণ : অভিনেতার কেরিয়ারের তৃতীয় ছবি। প্রথমবার সত্যজিতের ছত্রছায়ার বাইরে গিয়ে কাজ। তবে তপন সিনহার পরিচালনাতেও সেরাটা উজার করে দিয়েছেন সৌমিত্র। রবি ঠাকুরের ছোট গল্প ক্ষুধিত পাষাণ অলম্বনে তৈরি এই ছবি।

অভিযান: মানুষের অহংবোধ কতখানি মারাত্মক হতে পারে তাই সত্যজিত রায়ের অভিযানের উপজীব্য। তবে অংহবোধকে ছাপিয়ে মানবতাই যে শ্রেষ্ঠ তাও এই ছবিতে তুলে ধরেছেন পরিচালক। পুরোদস্তুর সিরিয়াস ছবি এটি। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের একই নামের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হয়েছে এই ছবি।

অরণ্যের দিনরাত্রি: সত্যজিৎ রায় পরিচালিত এই সিনেমা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত অরণ্যের দিনরাত্রি উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করা হয়েছিল। চার বন্ধু, অসীম, সঞ্জয়, হরি এবং শেখর, কলকাতার বাসিন্দা, ছুটিতে পালামৌ এর কাছাকাছি বেড়াতে আসা থেকে গল্পের শুরু।উচ্চাভিলাষী টগবগে যুবক, বড় কোম্পানির এক্সিকিউটিভ অসীমের ভূমিকাটি বোধহয় সৌমিত্র ছাড়া আর কেউই ফুটিয়ে তুলতে পারতেনন না। কীভাবে যে আপনি অসীমের প্রেমে পড়ে যাবেন এই ছবি দেখলে তা সত্যি কল্পনাতীত।

বসন্ত বিলাপ: শহরের বসন্ত বিলাপ নামক একটি হোস্টেলের মেয়েদের সঙ্গে পাশের ছেলেদের একটি হোস্টেলের ছেলেদের একে অপরের প্রতি বিদ্বেষ ও আক্রোশকে কেন্দ্র করেএই ছবির প্লট। সেই কারণেই দুই পক্ষই নিত্যনৈমিত্তিক ভাবে নতুন নতুন ফন্দি আঁটতে থাকে। যা এই হাস্য কৌতুকের মূল উপজীব্য। যদিও শেষে হোস্টেলের তিনটি মেয়ে, তিনটি ছেলের প্রেমে পড়ে। পুরো ছবিটাই কমেডি। কমেডি চরিত্রেও এতটুকু খামতি রাখেননি তিনি।

হীরক রাজার দেশে: হীরক রাজার দেশে বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় পরিচালিত একটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। রুপকের আশ্রয় নিয়ে চলচ্চিত্রটিতে কিছু ধ্রুব সত্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটি গুপী গাইন বাঘা বাইন সিরিজের একটি চলচ্চিত্র। এর একটি বিশেষ দিক হচ্ছে মূল শিল্পীদের সকল সংলাপ ছড়ার আকারে করা হয়েছে। তবে কেবল একটি চরিত্র ছড়ার ভাষায় কথা বলেননি। তিনি হলেন শিক্ষক। এই শিক্ষকের ভূমিকায় ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এর থেকে বোঝানো হয়েছে একমাত্র শিক্ষক মুক্ত চিন্তার অধিকারী, বাদবাকি সবার চিন্তাই নির্দিষ্ট পরিসরে আবদ্ধ। তাঁর গলায় ‘দড়ি ধরে মারো টান রাজা হবে খান খান’ এ যুগান্তকারী ডায়লগ হয়ে থাকবে।

তিন ভুবনের পারে: হয়ত তোমারই জন্য, জীবনে কি পাবো না… এই গান তো আজকের প্রজন্মের বাঙালিও গুনগুন করে। এতটাই ম্যাজিক্যাল সৌমিত্রর এই ছবি। লোফার থেকে আদর্শ প্রেমিক হয়ে উঠার জার্নি নিজের ক্যারিশ্মায় পরিচালক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের এই ছবিতে ফুটিয়ে তুলেছেন সৌমিত্র।

আরও পড়ুন: পাঁচ সপ্তাহের লড়াই শেষ, প্রয়াত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

ফেলুদা সিরিজ-: বাঙালির কাছে ফেলুদা আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দুটো সমার্থক শব্দ। স্রষ্টা সত্যজিতের ফেলুদা চরিত্র প্রাণ ঢেলেছেন অভিনেতা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কেরিয়ারগ্রাফের অন্যতম বড়ো প্রাপ্তি সোনার কেল্লা (১৯৭৪) ও জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৯) । আজ পর্যন্ত বাঙালি সৌমিত্র ব্যতীত অন্য কাউকেই ফেলুদা হিসাবে ১০০-তে ১০০ দিতে পারেনি।

গণশত্রু: সত্যজিত রায়ের কেরিয়ারের একদম শেষের দিকে ছবি। নরওয়ের লেখক হেনরিক ইবসেনের অ্যান এনিমি অফ দ্য পিপল অবলম্বনে তৈরি হয়েছিল এই ছবি। এই চলচ্চিত্রে প্রগতিশীল ডাক্তারের ভূমিকায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে পেয়েছে দর্শক। কান চলচ্চিত্র উত্সবে প্রতিযোগিতামূলক বিভাগে জায়গা করে নিয়েছিল গণশত্রু।

কোণি: একটু বয়সের ছাপ পড়েছে, সেইসময়ের ছবি ‘কোণি’। সাঁতার শিক্ষকের ভূমিকায় তাঁর চরিত্র আলাদামাত্রা দিয়ে গেছে। যে মাত্রার কোনও পরিমাপ হয় না। ‘ফাইট কোণি ফাইট’, বাংলার কত কোণিকে লড়াই করতে শিখিয়েছেন তিনি। শিক্ষক হোক এমন, তিনি সকলের পথপ্রদর্শক হয়ে রয়ে গিয়েছেন।

পদক্ষেপ ( ২০০৬): কোনও পুরস্কারই সৌমিত্রর অভিনয় দক্ষতার সঠিক মাপকাঠি হতে পারে না। তবুও পরিচালক সুমন ঘোষের এই ছবির জন্যই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মঞ্চে সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন সৌমিত্র। অশীতিপর বৃদ্ধ কীভাবে দ্রুত গতিতে পরিবর্তনশীল জীবনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন সেই নিয়েই এই ছবি। বহুল জনপ্রিয় না হলেও সৌমিত্রর কেরিয়ারের অন্যতম বহুল প্রশংসিত ছবি পদক্ষেপ।

প্রায় শ’তিনেক ছবির মধ্যে প্রায় সবকটিই সেরার সেরা। এমন কোনও চরিত্র নেই যা নিয়ে তাঁকে গর্ব করা যায় না। তিনকন্যা, পুনশ্চ, ঝিন্দের বন্দি, কাপুরুষ, পরিণীতা, অশনি সঙ্কেত, শাখা প্রশাখা, একাধিক ছোটবড় চরিত্রে তাঁর অভিনয় বাঙালি মনে বিরাজ করছে।

সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, তরুণ মজুমদার, অসিত সেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, ঋতুপর্ণ ঘোষের মত শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারদের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি।

অসুখ: এই চলচ্চিত্রটি তারকা মেয়ে, রোহিণী (দেবশ্রী রায়) এবং তার পিতা সুধাময় (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)-এর বিভেদ নিয়ে তৈরি, যিনি অনিচ্ছাকৃতভাবে তার মেয়ের উপার্জনের উপর নির্ভরশীল। রোহিণীর মা (গৌরী ঘোষ), যাকে হঠাত করে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। কেউ জানে না তিনি কোন কারণে অসুস্থ। এই অসুস্থতা রোহিণীর জীবনে বিভিন্ন ঘটনা ঘটায় এবং বাবার সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করে। পিতার ভূমিকায় সৌমিত্র সত্যিই শিল্পীসত্ত্বার মর্যাদা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন।

বেলাশেষে: আশিতে এসেও কোনও ছবির হিরো হওয়া যায়। তা বেলাশেষে ছবিতে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সৌমিত্র। শিবপ্রসাদ-নন্দিতা জুটির পরিচালনায় এই ছবির অন্যতম ইউএসিপি ছিল তিন দশক পর সৌমিত্র-স্বাতীলেখার রিইউনিয়ান। পাক-ধরা চুলের প্রেমও যে এতটা চোখ টানতে পারে তা বোধহয় আগে বুঝে উঠেনি বাঙালি।

আরও পড়ুন: সন্ধেতেই শেষকৃত্য, রবীন্দ্রসদনে শেষশ্রদ্ধায় শায়িত থাকবে কিংবদন্তী শিল্পীর মরদেহ

 

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on telegram
Share on whatsapp
Share on email
Share on reddit
Share on pinterest