ওয়েব ডেস্ক: পুরুষতন্ত্র তো মেয়েদের বুঝতে ভুল করেই এসেছে বরাবর, আমরা নিজেরাই কি নিজেদের চাওয়া-পাওয়াগুলোকে সম্মান জানাতে পেরেছি সব সময়? বিদ্রোহ তো আর হাতে অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে নামলেই হয় না – নিজের বিশ্বাসে অটল থেকে সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য মনের শক্তি লাগে। নিজের রোজের জীবনে, জীবনচর্যায় সেই শক্তির প্রকাশ দেখিয়েছেন যাঁরা, সেই সমস্ত মহিলাকে আমরা কুর্নিশ জানাই।
বাংলা চলচ্চিত্রে বাণিজ্যিক ধারার চেয়ে শৈল্পিক ধারার সিনেমা বেশ সমৃদ্ধ। তবে সব দেশের ন্যায় সেখানেও পুরুষকেন্দ্রীক সিনেমাই বেশি নির্মিত হয়। তবে বেশ কিছু সংখ্যক নারীকেন্দ্রিক সিনেমাও সেখানে বেশ দর্শকনন্দিত ও পুরস্কৃত হয়েছে। এরই মধ্যে সেরা ১০ টি সিনেমা নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন। পাঠকদের জানাবো এমনই দশটি ছবির গল্প, যা নারীদের প্রধান করে নির্মিত হয়েছে।
চলুন দেখে নেওয়া যাক সে তালিকায় কোন ছবিগুলো রয়েছে—
মেঘে ঢাকা তারা
মেঘে ঢাকা তারা ছবিতে দেশভাগের পর কলকাতায় শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নেয় একটি পরিবার। সেই পরিবারের বড় মেয়ে নীতা, সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে চাকরি করতে হয়। নানান দুঃখ কষ্টের মাঝেও সে স্বপ্ন দেখে। কিন্তু দিনদিন কাছের মানুষ গুলোই তাকে দূরে ঠেলে দেয়। একদিন তার বড় ভাই শংকর মুম্বাই থেকে বড় গায়ক হয়ে ফিরে আসে, কিন্তু ততদিনে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পাহাড়ের ওপর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় নীতাকে।জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে এসে, শংকরকে সে জানায় আরো কিছুদিন বাঁচতে চায় সে। আকাশে, পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনি হয় নীতার সেই আকুতি। ঋত্বিক ঘটকের নারী কেন্দ্রিক বাকি দুটি ছবি হল কোমলগান্ধা ও সুবর্ণরেখা।
উত্তর ফাল্গুনী
উত্তর ফাল্গুনী চলচ্চিত্রে দৃশ্যে দেখানো হয়েছে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে দেবযানীকে বেছে নিতে হয়েছে বাঈজীর জীবন। কিন্তু তার মেয়ে সুপর্ণাকে এই দুঃসহ জীবন থেকে মুক্তি দিতে পাঠিয়ে দেন কনভেন্টে। সেইখানেই সুশিক্ষায় বড় হয় সুপর্ণা, অন্যদিকে ততদিনে দেবযানী হয়ে উঠে বিখ্যাত বাঈজী পান্না বাই। ড.নীহাররঞ্জন গুপ্তের উপন্যাস অবলম্বনে এই ছবিতে এক মা ও মেয়ের গল্প তুলে ধরেন পরিচালক অসিত সেন। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই সিনেমাটি পরবর্তীতে বলিউডে রিমেক হয় ‘মমতা’ নামে, সেখানেও অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন, পরিচালক ছিলেন যথারীতি অসিত সেন।
মহানগর
মহানগর ছবিটি ১৯৫০ এর দশকে কলকাতা শহরের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি সুব্রত মজুমদারের গল্পে নির্মিত। এই ছবিতে তার স্ত্রী আরতি মজুমদারের দিন কাটে সাংসারিক কাজকর্ম করেই। পরিবারের আরো স্বচ্ছলতা আসার জন্য সুব্রত সবার অমতে চাকরিতে যোগদান করেন। হঠাৎ করে একদিন তার চাকরি চলে গেলে আরতিই হয়ে উঠেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষ – এ যেন গৃহবধূ থেকে কর্মঠ হয়ে উঠা এক নারীর জীবন সংগ্রাম।
আরও পড়ুন: Womens Day 2020: ছবিতে জয়গান নারীত্বের, শুভেচ্ছা পাঠান আপনার প্রিয়জনদের
একদিন প্রতিদিন
একদিন প্রতিদিন সিনেমায় নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র অর্থনৈতিক অবলমম্বন বড় মেয়ে ‘চিনু’। গল্পে দেখা যায়, হঠাৎ একদিন রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফেরে না সে, উৎকন্ঠা আশংকা শুরু হয় চিনুর মায়ের। কি হবে তার সংসারের? বাবা কিছুক্ষণ পর পর রাস্তায় আসেন মেয়ের খোঁজে। মায়ের এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক সীমাবদ্ধতার উৎকন্ঠার কারণ ছোট মেয়ে মিনু, সিনেমায় তা দেখানো হয়েছে বেশ আবেগ প্রবলভাবে।
পরমা
পরমা সিনেমায় দেখানো হয়েছে যৌথ পরিবারের লক্ষ্মী বৌমার (নাম চরিত্র পরমা) একটি অসাধারণ গল্প। একবার দূর্গাপূজায় ভাসুরের ছেলের বন্ধু আলোকচিত্রশিল্পী রাহুলের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। স্বামীর অনুমতিতেই পরমাও রাহুলের ক্যামেরায় ফটোসেশনের জন্য যান। সেখানে সে নিজেকে অন্যরুপে খুঁজে পান, নিজেকে সে আরো বিশদ ভাবে জানতে পারেন। ঠিক যেন মিসেস ভাদুড়ীর আড়ালে পড়ে থাকা পরমা নামটি যেন আবার খুঁজে পায়। ঘটনাপ্রবাহে সে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে রাহুলের সাথে, জানাজানি হলে মুহুর্তেই বদলে যায় পুরো ছবির দৃশ্যপট।নারীর আত্ম অনুসন্ধান এবং নিজের পরিচয়ে জীবন যাপনের আত্মবিশ্বাস অর্জন করার গল্প ছিল এর মূল প্রতিপাদ্য। প্রথিতযশা অভিনেত্রী ও নির্মাতা অপর্ণা সেনের জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত এই ছবিতে পরমা চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন রাখী গুলজার।
শ্বেত পাথরের থালা
প্রভাত রায়ের জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত সিনেমা ‘শ্বেত পাথরের থালা’য় বন্দনা নামক এক নারীর সংগ্রামের গল্প। এতে বন্দনা চরিত্রে অপর্ণা সেন ছিলেন দুর্দান্ত। এছাড়া অভিনয়ে ছিলেন ইন্দ্রাণী হালদার, দীপঙ্কর দে, ভাস্কর, সব্যসাচী চক্রবর্তী, ঋতুপর্ণা-সহ আরো অনেকে।
দহন
এতে দেখানো হয়েছে কলকাতায় মেট্রোরেলের স্টেশনের পাশে বখাটে ছেলের কাছে শারীরিক ভাবে নিগৃহীত হয় রমিতা, তার স্বামী পলাশ ও আহত হয়। এমন সময় তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে আধুনিকা ঝিনুক। শেষ অবধি এই ঘটনা পৌঁছায় আদালত পর্যন্ত। বখাটেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে ঝিনুক, কিন্তু সে কাছের মানুষ থেকেই বাধা পায়। অন্যদিকে এই ঘটনার পর ঝিনুকের কাছেও তার আপনজনেরা অচেনা হয়ে উঠে। ঝিনুক ও রমিতার পাশাপাশি যোগ হয় স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমে থাকা ঝিনুকের ঠাকুরমার জীবনবোধের গল্প। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের সত্য ঘটনা নিয়ে রচিত উপন্যাস অবলম্বনে অকাল প্রয়াত নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ নির্মাণ করেন অন্যতম সেরা সিনেমা ‘দহন’। এই ছবিতে ঝিনুক ও রমিতার চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে নেন ইন্দ্রাণী হালদার ও ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তা, আর ঠাকুরমার চরিত্রে ছিলেন সুচিত্রা মিত্র।
পারমিতার একদিন
পারমিতার একদিন ছবিতে শনকা ও পারমিতা সম্পর্কে শ্বাশুড়ী- পুত্রবধূ। বয়স, চিন্তাভাবনায় পার্থক্য থাকলেও দু’জনে নিজেদের একসূত্রে গেঁথে ফেলেছিলেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে দুই জনের মাঝে গড়ে উঠেছিল বন্ধুত্ব, এমনকি পারমিতার বিচ্ছেদ হবার পরেও তার বন্ধু ছিলেন। শনকার শ্রাদ্ধের দিন পারমিতার সামনে ভেসে উঠেছিল নিজেদের অতীত ও বর্তমান। সিনেমাটিতে শনকা চরিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি নির্মাতা ছিলেন গুণী অপর্ণা সেন, আর পারমিতা চরিত্রে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তা। দু’জনেই নিজেদের সেরাটা দিয়ে ছিলেন ছবিতে। সঙ্গে যোগ হয়েছিলেন সোহিনী সেনগুপ্তা। তিনিও পেয়েছেন ছবিটির জন্য জাতীয় পুরস্কার। একাধিক শাখায় জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত এই ছবিতে আরো অভিনয় করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
বাড়িওয়ালী
নিসঙ্গ মধ্যবয়সী নারী বনলতায় ছিল বাড়িওয়ালার মূল চরিত্র। এক বিশাল বাড়ির মালিক তিনি। সঙ্গী হিসেবে থাকে কয়েকজন গৃহপরিচারক। বাড়িতে আসে সিনেমার লোকজন, তাতে চলে শুটিং। একসময় তার একাকীত্বের মাঝে ফিরে এলো চঞ্চলতা। ছবির পরিচালকের সাথে গড়ে উঠে অন্যরকম সম্পর্ক।এইরকম গল্প নিয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ নির্মাণ করেন ‘বাড়িওয়ালী’। এই ছবিতে অভিনয় করে কিরন খের ও সুদীপ্তা চক্রবর্তী জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে নেন।
বিসর্জন
এই ছবিতে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তের এক নদীতে নাসের নামের এক ভারতীয় মুসলমানকে অচেতন অবস্থায় পান বাংলাদেশের হিন্দু অকাল বিধবা নারী পদ্মা। তাকে তিনি বাড়িতে নিয়ে এসে সুস্থ করে তোলেন। এরপর নাসের আর পদ্মার মাঝে গড়ে উঠে সম্পর্ক। অন্যদিকে গণেশ মণ্ডলের দৃষ্টি পদ্মার দিকে, সেও ভালোবাসা দিয়ে পদ্মাকে জয় করতে চায়।এই সময়ের সবচেয়ে প্রশংসিত নির্মাতা কৌশিক গাঙ্গুলীর জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত সিনেমা ‘বিসর্জন’। তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন পদ্মার কাহিনী। আর বিসর্জন সিনেমার প্রধান ভূমিকায় জয়া আহসান অভিনয় করে অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছেন। এছাড়া গনেশ মণ্ডল চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন স্বয়ং পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলী।
এছাড়াও বেশ কিছু সিনেমা রয়েছে যা ছাড়া এই তালিকা অসম্পূর্ণ। সেগুলি হল- ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ছবিতে নার্সের চরিত্রে দেখা যায় সুচিত্রা সেনকে। মনোরোগ সারিয়ে তোলার অভিনব নয়া পদ্ধতির সন্ধান শুরু হয়েছিল ওই সময়ে। নারীকে চিরকাল আশ্রয় ও শুশ্রুষার প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু নারীর আশ্রয় কে? এই প্রশ্ন তোলে এই ছবি। বসন্ত চৌধুরী, পাহাড়ী সান্যাল, তুলসী চক্রবর্তীরা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে থাকলেও ছবির একজনই হিরো, তিনি সুচিত্রা সেন।
‘দেবী’ ছবিতে আবার নারীর ছদ্ম-ক্ষমতায়নকে কড়া সমালোচনা করেছেন সত্যজিৎ। দয়াময়ী ও উমাপ্রসাদের (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) বিয়ের পর, উমাপ্রসাদ কলকাতায় পড়তে চলে যায়। বৃদ্ধ শ্বশুরের দেখাশোনা করে দয়াময়ী। একদিন স্বপ্নে পুত্রবধূকে মা কালীর রূপে দেখে সে। কিন্তু দয়াময়ী তো দেবী নয়, মানবী হতে চেয়েছিল! নারীত্বে পুরুষতন্ত্র যখন দেবীত্ব আরোপ করে তখন তা কতটা ভয়াবহ, তা দেখিয়েছেন সত্যজিৎ।
সাহিত্যনির্ভর নারীকেন্দ্রিক ছবিগুলির মধ্যে অবশ্যই সেরা ছবি চারুলতা (১৯৬৪)- সত্যজিৎ রায়। আর একটি উল্লেখযোগ্য নারীকেন্দ্রিক ছবি– শতরূপা সান্যালের অনু। একটি বাণিজ্যিক নারীকেন্দ্রিক বাংলা ছবি যা বক্স অফিসেও বিপুল সাড়া ফেলে– তরুণ মজুমদারের আলো।