এ দেশ ধর্মমুখী। আর কোনও অধিকার বুঝে নেবার তাগিদ থাক আর না থাক ধর্মীয় অধিকার বুঝে নেবার তাগিদ এদেশের বারো আনা মানুষের। ধর্ম আসলে কী, তা বেশিরভাগের কাছে স্পষ্ট নয়। যদি স্পষ্ট হত, তাহলে মন্দিরে দলিতকে পিটিয়ে মারা হত না। মানুষ মারাকে যারা জেহাদ মনে করে ধর্মের সঙ্গে তাদের যোগ নেই। ধর্মের নাম করে নানা অনাচার ও গোঁড়ামি মানুষের মনে আশ্রয় নেয়। ধর্ম এমন একটা বিষয়, খেয়ে না খেয়ে মানুষ আজও এদেশে ধর্মের পরিচয় হারাতে চায় না। এই পরিচয় নিয়েই মানুষ বাঁচে।
ভারতের সংবিধান বলে, এক জন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের পূর্ণ অধিকার আছে নিজের ধর্ম বেছে নেওয়ার । এই অধিকার সংবিধান-স্বীকৃত। সম্প্রতি এক জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কথাটি ফের স্মরণ করিয়ে দিল দেশের সুপ্রিম কোর্ট। প্রসঙ্গত, যে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই রায়, তা আসলে ছিল ধর্মান্তরকরণ নিয়ে। এক বিজেপি নেতা সুপ্রিম কোর্টে এই মর্মে আবেদন করেছিলেন যে, আদালত যেন ধর্মান্তরকরণ রোধ করতে কড়া কেন্দ্রীয় আইন প্রবর্তনের জন্য নির্দেশাবলি জারি করে। আবেদনটি নিয়ে গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট । এবং তাকে ‘অত্যন্ত ক্ষতিকর’ আখ্যা দিয়া সেই নেতাকে সতর্কও করেছে ।
আরও পড়ুন : ভাঙল ঘুম? ২ শাহি স্নানের পর ‘প্রতীকী’ কুম্ভমেলার আর্জি মোদীর
যে সতর্কীকরণ সুপ্রিম কোর্ট করেছে তা এই সময়ের দাবি। দেশে রাজনৈতিক দিক থেকে নাগরিকদের সংবিধান-স্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলি প্রায় নিয়মিত লঙ্ঘিত হচ্ছে । কেউ যদি মনে করেন ভারত ‘ধর্মনিরপেক্ষ দেশ’ , একথার অর্থ এখানে শুধুমাত্র বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করেন, তা হলে তা ভুল হবে। ভারতীয় সংবিধানে নাগরিকদের আরও কিছু অধিকার আছে । স্বেচ্ছায় নিজের ধর্ম বেছে নেওয়া যেমন সেই অধিকারের মধ্যে পড়ে, তেমনই নিজ ধর্ম প্রচারের স্বাধীনতাও তার অন্তর্ভুক্ত। দুর্ভাগ্য, এই উদারতা, সমন্বয়বাদিতা, এবং সর্বোপরি সহিষ্ণুতার আদর্শটি বর্তমানে ভয়ঙ্কর ভাবে বিপন্ন।
বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ’ বন্ধ করার নামে ব্যক্তিগত পরিসরে হস্তক্ষেপের এক প্রবল অপচেষ্টা দেখা যাচ্ছে । উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত-সহ একাধিক বিজেপি-শাসিত রাজ্যে ‘লাভ জেহাদ’-এর অজুহাতে ধর্মান্তরকরণ রুখতে কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে । শুধুমাত্র ধর্মই নয় , নাগরিক কী খাবেন, কেমন পোশাক পরবেন, কারসঙ্গে সঙ্গে সম্পর্ক গড়বেন, সেই সব ব্যক্তিস্বাধীনতাকে অগ্রাহ্য করে নাগপুর-স্বীকৃত এক গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ চাপাবার নিরন্তর অপচেষ্টা চলছে। গণতন্ত্র এবং সংবিধান-প্রদত্ত অধিকারগুলি সুরক্ষিত রাখবার জন্য তাই মানুষের শেষ ভরসা সেই সুপ্রিম কোর্ট ।
সুপ্রিম কোর্টের ওপর আম জনতার ভরসা বহু দিনের। যদিও সেখানেও সাধারণ মানুষ বিশেষ করে মুসলিমরা আর আগের মত বিশুদ্ধ বিশ্বাস রাখতে পারছেন না। অযোধ্যা রায় তাদের অনেকেরই মনরাজ্যে বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে একটা উদাসীনতা ও অসহায়তা তৈরী করেছে। শীর্ষ কোর্ট যখন কেবল বিশেষ ধর্মের ‘আস্থায়’ চলে তখন আর যায় হোক বিচারব্যবস্থার ওপর পূর্ণ আস্থা রাখা যে কোনও বোধসম্পন্ন মানুষের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।আস্থায় রায় দেওয়া বিচারপতি যদি রায় দানের কয়েক মাসের মধ্যে বিজেপির টিকিটে রাজ্যসভার সাংসদ হন, তাহলে তো কথায় নেই। বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে সেক্ষত্রে জনমনে একটা সন্দেহ যুক্তির খাতিরেই তৈরী হয়।কেবল রক্তচক্ষু দিয়ে তাকে অস্বীকার করা কঠিন।
গেরুয়া ভেকধারীরা অনেকেই নিজেদের দুর্বলতা অন্য ধর্মের ওপর চাপানোর চেষ্টা করে। সনাতন ধর্ম প্রাচীন। এই ধর্মের কোমল দিকগুলি নিয়ে ভিনধর্মের মানুষের কাছে যাওয়া যেতেই পারে। এই ধর্ম কত মহান সে কথাও উত্থাপন করা যেতে পারে। চাইলে কেউ হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করবেন। না চাইলে করবেন না। কিন্তু তা না করে যখন ভালোবাসাকে জিহাদের নামান্তর করা হয়, তখন প্রাচীন এই ‘সাংস্কৃতিক’ ও ‘দার্শনিক’ ধর্মটিকেই অপমান করা হয়। সনাতন ধর্মের তুলনায় ইসলাম একেবারেই নবীন ধর্ম। খিস্টান কিংবা বৌদ্ধ ধর্মও তাই। তারপরও ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্ম যেভাবে বেড়েছে, হিন্দু ধর্ম বাড়েনি। বরং ধর্মের নাম করে দলিতদের ওপর নিগ্রহ চলছে আজ। সার্বিকভাবে এই নিগ্রহের পরিবাদ করে হিন্দুরা কখনও পথে নামেনি। বরং এটি তাদের অদৃষ্ট, একথা বোঝানোর চেষ্টা হয়ে নানা পৌরাণিক গল্পের ভিতর দিয়ে। ফলে এই মানুষগুলোকে কালে কালে টেনে নিয়েছে যীশুর ধর্ম ও ইসলাম।
যাদের মন্দিরে ঠাঁই দেওয়া গেলনা আজ তাদের সবথেকে বেশি দরকার গেরুয়া পার্টির। দলিতদের ও নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের তাই বিদ্বেষ দিকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে আন্তরিকভাবে। এই বিদ্বেষ মুসলিমের বিরুদ্ধে ছাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের ভিতরে বহুকাল ধরেই একটা রাগ ধিক ধিক করে জ্বলছে। আরএসএস ও বিজেপি কেবল সেটির অভিমুখ বদলে দিয়েছে কৌশলে। আজকে এই দলিতদের অনেকের মুখেই মুসলিম বিদ্বেষ। তারা সেটা গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করছে।
সংবিধানে যে ‘ধর্মপ্রচার’ শব্দটিকে জায়গা দেওয়া হইয়াছে,তার পিছনে একটি সুনির্দিষ্ট যুক্তি আছে। অর্থাৎ, প্রত্যেক ভারতবাসীর নিজ ধর্ম পালন এবং সেই ধর্মের প্রতি অন্যদের উদ্বুদ্ধ করিবার সমান অধিকার আছে। রাষ্ট্র কোনও ভাবেই তাতে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এবং সেখানে বলপ্রয়োগেরও স্থান নাই। এই কথাটি বিশেষ করে বিজেপি সরকারের মনে রাখা প্রয়োজন। বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ বলতে তারা সংখ্যালঘুদের উদাহরণ টানে । অথচ, নিজেদের ‘ঘর ওয়াপসি’-র কর্মসূচিটিও যে সেই বলপ্রয়োগেরই নামান্তর, সেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায়। এটা ঘোরতর অসাংবিধানিক।
আরও পড়ুন : আমেরিকায় ফের বন্দুকবাজের হানা, মৃত কমপক্ষে ৪ শিখ-সহ ৮, শোকপ্রকাশ ভারতের