সৈয়দ আলি মাসুদ
রাজনীতিতে মিথ্যাচার, দুর্নীতি আগেও ছিল। এখনও আছে। তাতে এত কপচানোর কি আছে? ভাবছেন অনেকে। একটা ফারাক খালি চোখে দেখা যাচ্ছে । আগে মিডিয়া অন্যায়কে অন্যায় বলতে চেষ্টা করত। তখনও মিডিয়া ব্যবসা করেই খেত। কিন্তু এমন নির্লজ্জ হয়ে ওঠেনি। কথায় কথায় লোকে বলে সব নাকি মোদী জমানায় হয়েছে। তার জমানাতেই নাকি মিডিয়া ‘মোদীয়া’তে পরিণত হয়েছে। দেশের বেশিরভাগ বড় মিডিয়া ‘মোদীয়া’ হয়ে উঠেছে। তাই মিডিয়া দেখে দেশের বর্তমান অবস্থার হাল বোঝা আর সম্ভব নয়।
তাহলে উপায় ? আরে বাবা নিজের বুদ্ধিতে বুঝুন। বউয়ের মুখ ভার কেন, তা কি আপনাকে টিভি দেখে বুঝতে হবে! বাবার মুখ কেন এমন থমথমে হয়ে আছে, তাকি আপনি প্রাইম টাইম দেখে বোঝেন? সবটাই বোঝেন অভিজ্ঞতা ও ঘটনার পারস্পরিকতা দিয়ে। গুমোট গরম হলে আপনিও বলেন, ‘আজ-কালের মধ্যে বৃষ্টি হবে’ তার জন্য কি আপনাকে গণেশদার ওপর নির্ভর করতে হয়? আজকের দিনে ধান্দা ছাড়া মিডিয়ার কোনও কাজ নেই। বহু দিন ধরেই মিডিয়া ধান্দার চেষ্টা করে আসছে। কিন্তু সেরকম ‘স্পন্সর’ পাচ্ছিলো না।মোদী জমানায় তারা বেশ ‘রসে বসে’ আছে। সবাই যেন ‘হরি সেন’। সুমুদ্র গুপ্তের সভাকবি হরি সেন ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’ রচনা করেছিলেন। নামকরণেই স্পষ্ট ছিল ‘ডিসক্লেমার।’ বোধহয় কবি বলতে চেয়েছিলেন, ‘বিশ্বাস করার দরকার নেই, সবটাই রাজাকে খুশি করতে লিখেছি।’
মিডিয়া ওরফে ‘মোদীয়ার’ সে সাহসও নেই। সোজা কথা মিডিয়াকে স্রেফ বিনোদন হিসাবে দেখুন। কমিডি মনে করুন। আইপিএল ভাবুন। রগরগে ওয়েব সিরিজ ভাবুন। তাহলে ল্যাটা চুকে যায়। যারা বলেছিল মিডিয়া নাকি গণতন্ত্রের চুতুর্থ স্তম্ভ তারা সেই জুরাসিক যুগ পর্যন্ত খাবি খেয়েছেন। তারপর টপকে গিয়েছেন। এটা ‘নিউ ইন্ডিয়া’! নামটা অবশ্য যোগী আদিত্যনাথ মোদীজিকে গোপনে দিয়েছিলেন কিনা এমন কোনও খবর সূত্র মারফতও মেলেনি। যায় হোক এটা নিউ ইন্ডিয়া। এটা ‘আত্মনির্ভর ভারত’। এখন আদালতে ‘আস্থা’ অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ। তথ্যপ্রমাণ থাকলেও চলবে, না থাকলে মন্দ না।
নিউ ইন্ডিয়াতে দুটো জিনিসের উন্নতি দেখলে আপনার মন ভরে যাবে। মিডিয়া ও বিচার ব্যবস্থা। কিছু বিচারপতি আজকের দিনেও শিরদাঁড়া টান করে থাকার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তারা ওই রবীশ কুমার গোছেরই। বাকি অনেকেই বিজেপি নেতার হার্লে ডেভিডসন বাইকে পোজ দেওয়া, কিংবা ‘আস্থায়’ রায় দিয়ে রাজ্যসভায় ঢুকে পড়া। মিডিয়া এবং বিচার ব্যবস্থা সত্যিই গণতন্ত্রের খাম্বাকে এমন মজবুত করেছে যে জেসিবি দিয়েও আর ভাঙা যাবে না! তবে প্রশান্ত কিশোর নাকি তাই মাঝেই সুপ্রিম কোর্টের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন ! যাইহোক এক টাকা জরিমানা করে হৃত গৌরব সুপ্রিম কোর্ট ফিরিয়ে এনেছে।
মিডিয়ার ভূমিকাটা চিরদিনই খানিকটা তরল। কখন কোন ইস্যুতে কোন হাউস কি ভূমিকা নেবে তা বোঝা যেত না। ভারতে তখন নীলকররা অত্যাচার চালাচ্ছে। এই নীলকরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ‘হিন্দু পেট্রিয়টিক’ পত্রিকার সম্পাদক হরিশ মুকুজ্জে। কিংন্তু তিনিই আবার সিপাহী বিদ্রোহের সময় সিপাহীদের বিরোধিতা করেছিলেন তাঁর পত্রিকায়। এটা ছিলই। কংগ্রেস জমানার বহু দুর্নীতি সামনে এসেছে মিডিয়ার মাধ্যমেই। সম্ভবত জরুরী অবস্থা জারি করা ইন্দিরা গান্ধী ওরফে ‘মা দুর্গা'(সম্বোধন অটলিজির) ও মনে করতেন মিডিয়ার কাজ কেবল তাঁর ভজনা নয়।
কিন্তু কংগ্রেস যুগের সব নিশানি মুছে দিতে চাইছে মোদির ‘নিউ ইন্ডিয়া’। অনেকে বলে গাই ও যোগী বাদ দিলে কংগ্রেস ও মোদীর বিজেপিতে ফারাকটাই বা কি আছে? তাই বহিরঙ্গে ফারাক বোঝানোর দায়িত্ব নিয়েছে মিডিয়া ওরফে অধুনা ‘মোদীয়া।’ এর অন্যথা হলেই সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ। কেবল সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধই নয় , কর্পোরেট বিজ্ঞাপনও কাটি করে বন্ধ করে দেবে সরকার। তখন গায়ে ব্লেজার চাপিয়ে গোস্বামী ‘ভুতি চুষবে’ ? তাই সরকারকে সবথেকে বড় ‘বাবু'(খদ্দের) হিসাবে দেখে খ্যাতনামা ‘প্রেস্টিটিউট’ রা।
যেহেতু মোদী সরকার বর্তমানে ‘ওয়ানম্যান’ সরকার তাই এই ধরণের প্রেস্টিটিউটদের চাপ কমে গিয়েছে। মোদীর ভক্তকুল কম নয়। যাদের মাথায় ‘রং নাম্বার’ আগেই ভরে দেওয়া হয়েছে। চাকরি চাইলে যাদের বলে দেওয়া যায় ‘সিয়াচেন আমাদের জওয়ানরা লড়ছে’। যাদের বলা যায় ‘ইমরান খান ও পাকিস্তানের দফা রফা’। যাদের বলা যায় ‘দেখেছো মোদী জমানায় মুসলিমরা আর টুঁ শব্দটি করতে পারছে না’। যাদের মাথায় রং নাম্বার ভরা তারা মেগা সিরিয়াল দেখা দর্শকদের মত।
সবশেষ আবার বলে রাখি, কারও কথা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করবেন না। মিডিয়া ওরফে ‘মোদীয়া’র কথা তো নয়ই। ভাবছেন, কেবল মোদী মিডিয়া মিডিয়া কন্ট্রোল করে ? বাকিরা ধোয়া তুলসী পাতা? রাজ্যে রাজ্যে যে আঞ্চলিক চ্যানেলগুলি আছে তারা কী তবে যুধিষ্ঠিরের চরণামৃত খেয়ে এসেছে? না ,তা নয়। ফান্ডা সেই একই। শাসকদলকে খুশি রাখতেই হবে। এই অসুস্থ বেলাগাম সংস্কৃতি আসলে বোধহয় ‘বিকাশের’ ই অঙ্গ। এখন তা করোনার মত ছড়িয়ে পড়েছে। সবাই চাইছে শাসক দলকে খুশি করে দু’পয়সা কামিয়ে নিতে। আগে সরকার বলে একটা বস্তু ছিল। এখন সবটাই শাসক দল। কেন্দ্র -রাজ্য সর্বত্র এই অসুখ। ভক্তরা যা খুশি ভাবুক, বলুক। যারা ভক্ত নন তাদের কাছে প্রার্থনা গরুকে ধারাপাত শেখাতে যাবেন না।
অভিমত ব্যক্তিগত