সৈয়দ আলি মাসুদ
এখনও মানুষ আছে। বিশ্বাস আছে। আশ্বাস আছে। সব চুলোয় এখনও যায়নি। চারিদিকে চোর, ডাকাত ও লুটেরাদের খবর করতে করতে মনে হতাশার শ্যাওলা জমে গিয়েছিল। সে শ্যাওলা যে পুরোপুরি নির্মূল হয়েছে তা নয়। তবে হতাশা কমেছে। আসলে নিজের জীবন দিয়ে যে বোধ অনুভূতি তৈরী হয়, তার গভীরতা অনেক বেশি। ভালো মানুষের খবর, সাধারণ জনের সততার খবর বহুবার করেছি। সৎ মানুষের সঙ্গও পেয়েছি। কিন্তু সেদিন যা ঘটল তা একপ্রকার মিরাকেল।
ঈদের দুদিন আগে। কলকাতা থেকে বর্ধমান ফিরছিলাম। এসবিএসটিসি বাসে। সঙ্গে দাদা ও স্ত্রী।বর্ধমানের আলিশা বাসস্টপে নেমে পড়ি। সাধারণত সেখান থেকে টোটো নিয়ে বাড়ি ফিরি। এদিনও তেমন ভাবনাই ছিল। আমার বাড়ি বর্ধমানের বড় বাজার। টোটোওয়ালা গুমোর দেখাল। যাওয়ার ইচ্ছে নেই। এসব ক্ষেত্রে তাদের কৌশল হল অতিরিক্ত ভাড়া বলা। যদি যাত্রী রাজি হয়ে যায়, ভালো। তা না হলেও অসুবিধা নেই। এদিনও তাই হল। সামনে একটা বাস যাত্রী নিয়ে স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল। বাসের পিছনে যে জায়গাগুলির নাম লেখা ছিল তা আমাদের চেনা ছিল না। তবে কন্ডাক্টর বলল কার্জনগেট যাবে। সেখান থেকে আর একটা টোটো নিতে হবে। যাকগে। কি আর করা? বাসে চেপে পড়লাম তিনজনেই।
কার্জনগেটের একটু আগেই নেমে পড়লাম। কাছেই টোটো দাঁড়িয়েছিল উঠে পড়লাম। সোজা বাড়ি। গিয়ে পোশাক বদলানোর জন্য ব্যাগ খুঁজতে গিয়েই মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। আশংকায় আমার দাদা ও স্ত্রীর মুখ সাদা হয়ে গেল। আমারও কেঁদে ফেলার অবস্থা। স্পস্ট শুনতে পাচ্ছিলাম নিজের হৃদস্পন্দন। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। বাসের নাম পড়েছিলাম পিছন থেকে। সেটাই সকলে মনে করতে চেষ্টা করলাম। সকলে মানে, আমি আর দাদা। স্ত্রীর চোখে চশমা ছিল না বলে সে বেচারি বাসের নাম পড়তে পারেনি। তাছাড়া এরকম ক্ষেত্রে সকলে মিলে বাসের নাম খেয়ালও করে না। সামনে যারা থাকে তাদের অনুসরণ করে। সেও তাই করেছিল। আবছা আবছা করে বাসের নাম মনে করতে পারলাম। তারপর দৌড় দিলাম।
একটা টোটো নিলাম। বললাম স্টেশন চুলুন। কারণ বাসটার সেই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার কথা। টোটো চালক ভদ্রলোক প্রথম একা বলে আমাকে চড়াতে রাজি হচ্ছিলেন না। পরে ব্যাপারটা খুলে বলাতে রাজি হলেন। তাড়াহুড়োয় মোবাইল আনতে ভুলেছিলাম। টোটো চালক ভদ্রলোক। তার গাড়ি চালানোর গতিও অতিশয় ভদ্র। আমি সেই ভদ্র গতির চোটে অস্থির হয়ে উঠছিলাম। তাও গলা স্বাভাবিক রেখে বললাম, ‘দাদা আর একটু জোরে যাওয়া যায় না?’ তিনি খানিকটা বিরক্ত মুখে বললেন, ‘দেখছেননা রাস্তা খারাপ।’ অথচ আমার পাশ দিয়ে বাকি টোটো শোঁ শোঁ করে পার হয়ে যাচ্ছিল। আমি দেখলাম কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। বর্ধমান রেলস্টেশনের ফ্লাইওভারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাফিক পুলিশকর্মীদের কাছে সমস্যার কথা বলে তাদের সাহায্য চাইলাম। আমি যে বাসটির নাম বলছি, সেটিকে কেউ চিনতে পারছে না। বিপদটা বাড়ছিল সেখানেই ।
বাড়ির লোক যে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে সে উপায় নেই। মোবাইল ফেলে এসেছি, একথা বলায় এক পুলিশকর্মী তাঁর মোবাইল ব্যবহারের অনুমতি দিলেন। বাড়িতে জানিয়ে দিলাম যে আমি গাড়ি ভাড়া করে বাসের পিছনে যাচ্ছি। ট্রাফিকে থাকা পুলিশ কর্মী মিস্টার আনসারী নিজে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে নিয়ে যান আমাকে। ট্যাক্সিওয়ালাদের ডেকে আমার সমস্যার কথা বলেন। আমার কাছে মাত্র ২০০ টাকা ছিল। আমার দাদা তা জানত। আমার মাসতুতো ভাই তড়িঘড়ি নিজের টাকা নিয়ে সাইকেলে চড়ে আমাকে টাকা দিতে আসছিল। কিন্তু ততক্ষনে আমার তুষারের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছে।
তুষার আমার আশা। তাঁর গাড়িতেই আমি রওনা দিই।ভাড়ার কথা তিনি একটিবারের জন্য জিজ্ঞাসা করেনি। তিনি আমার সঙ্গে কিছুক্ষন কথা বলার পর বলেন পেয়ে যাব।বাসটির পিছনে লেখা ছিল ‘জামাড়’ এবং ‘কোড়ার’। কিন্তু আমি খুব জোরের সঙ্গে বলছিলাম ‘কাড়ার’ এবং ‘পোড়ার’। তুষারের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে আমি ভুল নাম বলছি। সে কেবল একটা কথায় বলছিল, ‘বেশিদূর যায়নি। পেয়ে যাব।’
তাঁর এই ইতিবাচক আত্মবিশ্বাসে আমার মনে নিভতে বসা আশার সলতেটা একটু একটু করে উজ্জ্বল হচ্ছিল। এক জায়গায় গিয়ে তিনি মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘জামাড়-এর বাসটা গেলো?’ মোড়ের মাথায় থাকা লোকজন বলল, ‘হ্যাঁ।’ ‘কতক্ষন আগে?’ ‘এই মিনিট দশ।’ আমার বাড়ি যাওয়া, ফের ফিরে আসা, গাড়ি ধরে আসা, সবটা ক্যালকুলেশন করলে সময়টা মিলে যায়। আশা আরও বাড়ছিল। তুষার আবার বললেন, ‘বাস পেয়ে যাব। ব্যাগ যদি বাসে থাকে পেয়ে যাব।’ আরও খানিক্ষন যেয়ে তুষার বললেন, ‘ওই দেখুন বাস’ আমার নজরে পড়েনি। কিন্তু তাঁর পড়েছে। বাসটি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিল। আমি দেখলাম। কিন্তু এটাই কি ? আমি বাসটাকে দেখেছিলাম পিছন থেকে। ফলে সামনে থেকে বাসটাকে চিনতে পারছিলাম না। তুষার জোর দিয়ে বলেন, ‘ওটাই আপনার বাস। উঠুন। দেখুন। ওইতো। ওইতো। কালো একটা ব্যাগ। ওটাই আপনার ব্যাগ।’ আমি বাসে উঠে দেখলাম আমার ব্যাগ সেই একই জায়গায় আছে। বাসের কন্ডাক্টর আমাকে দেখে চিনতেও পারলেন। কারণ আমার ওঠার সময় বাসটা প্রায় ফাঁকা ছিল।
ব্যাগটা পেয়ে ওপরওয়ালা ধন্যবাদ দিই। সঙ্গে নিচেওয়ালকেও। মানে তুষারকে। তাঁর জন্যেই এই ব্যাগ উদ্ধার হয়েছে। ব্যাগ চলে যাওয়ার দায় ছিল আমার। ব্যাগ ফিরে পাওয়ার কৃতিত্ত্ব তুষারের। এই ব্যাগে আমার ল্যাপটপ ছিল। কলকাতার ফ্ল্যাটের চাবি ছিল। আমার ও আমার স্ত্রীর আধারকার্ড ছিল। হাজার সাতেক টাকা ছিল। এবং আমার স্ত্রীর মোবাইল ফোন ছিল।
আমি এমনিতেই চৌখস মানুষ নয়। খানিকটা উদোমাদা গোছের। বাড়ির লোকজন তাই এই বয়স পর্যন্ত আমাকে নিয়ে চাপে থাকে। যাইহোক ব্যাগ ফিরে পাওয়ার পর তুষারকে জিজ্ঞাসা করলাম কত দেব। তুষার যা বলবে তাই দেব। মনস্থির করেছিলাম। তুষার বারোশ টাকা চাইল। কিন্তু আমি উত্যেজনার বসে তাঁকে দিলাম দুহাজার। সামান্য হেসে তুষার বলল আমি বারোশ চেয়েছি। আপনি মাথা ঠান্ডা রাখুন।
আমি না হয়, নিজের ভাগ্য এবং তুষারের উদ্যোগে ব্যাগ পেলাম। কিন্তু তুষার এমন আত্মবিশ্বাসী ছিল কেমন করে। সে কথা তুষার নিজেই জানাল। সে বলল, এই নিয়ে তিনবার গাড়ি তাড়া করে, তিনবারই সফল হলাম। একবার বর্ধমান থেকে গিয়েছিলাম ধর্মতলা। একজন ব্যাগ ফেলে এসেছিলেন। ব্যাগে ছিল লাখ চারেক টাকা। ধর্মতলায় গিয়েও ভদ্রলোক বাস চিনতে পারছিলেন না। কিন্তু সেবার তুষার ঠিক দেখতে পায়ে যান। তিনি সযত্নে ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে ওঠেন। ভদ্রলোক দেখতে পাননি। তুষার ভদ্রলোককে ডেকে নেন। ফিসফিসিয়ে বলেন, ‘এখানে হাঁউমাঁউ করলে মুশকিলে পড়বেন। পুলিশের ঝামেলায় পরে যাবেন। পুলিশ বলবে, এই টাকা যে আপনার তার প্রমাণ দিন। বিপদে পরে যাবেন। মিডিয়া জুট যাবে। তাড়াতাড়ি টাকা দেখে নিয়ে ফিরে চলুন’ ওই টাকার মালিক পরে ট্যাক্সি ভাড়া নিয়ে তুষারের সঙ্গে ঝামেলা করেছিল। তুষার সে কথা ভোলেনি। আমি হলেও ভুলতাম না।
নোটবন্দির ঠিক পরের দিন নতুনহাটের এক ইলেক্ট্রিকের দোকানদার বাসে টাকা ফেলে বর্ধমানে নেমে পড়েন। বাস চলে যায়। সেই বাস ধাওয়া করেন তুষার। বহরমপুরগামী বাস থেকে উদ্ধার করেন টাকার ব্যাগ। সে কারণেই তুষার এমন আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।
আমাদের মত উদোমাদা মানুষদের জন্য ওপরওয়ালা কোনও না কোনও তুষারকে ঠিক করে রেখে দেন। ওপরওয়ালা আমাদের মত মানুষদের ওয়ার্নিং দেন। সাবধান হতে বলেন। আমরাও তো আর ইচ্ছা করে ভুলে যায় না। ভুল হয়ে যায়। মারাত্মক ভুল হয়ে যায়। এমন কোনও না কোনও মারাত্মক ভুল হয়তো সবার জীবনে একবার না একবার ঘটেছে। কিন্তু প্রতিবার ওপরওয়ালা তুষারদের পাঠান না।
ব্যাগ ফিরে কথা যখন আমার দিদিকে বললাম, সে আরও একবার বুক ফাটা আর্তনাদ করে বলল, ‘ওপরওয়ালা আমার বাচ্চাটাকে কেন এমন করে ফিরিয়ে দিল না? কেন ?’ জবাব নেই। কারও কাছে উত্তর নেই। ১০ বছরের একমাত্র সন্তানকে যে ওপরওয়ালা তার মায়ের কোল খালি করে নিয়ে নেয়, তাকে কি সান্তনা দেওয়া যায়? আমার আদরের ভাগ্না দানিয়াল, গত ১০ জুলাই মায়ের কোল খালি করে মাটির ঘরে চলে গিয়েছে। দিদির হাজার আকুতি, প্রার্থনায় ওপরওয়ালা ফিরিয়ে দেননি তাঁর সন্তানকে। আমার মা কবি ছিলেন। তিনিও সন্তান হারিয়েছিলেন। ডাক্তারি পড়া ছেলে। আমার মা’র, কবিতার একটি লাইন হল, ‘সৃষ্টির বুকে বিধাতার খেলা বলিবার কিছু নাই, আমরা ক্ষুদ্র অসহায় জাতি, নীরবে নিরখি তাই।’ সত্যিই তাই। নীরবে দেখে যাওয়া ছাড়া আসলে কিছু আমাদের হাতে নেই।
সেদিন আরও একবার বুঝলাম বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের এই দোলাচলর নামই জীবন। প্রার্থনা পুরো হওয়া আর না হওয়ার নামই জীবন। পেয়ে হারানো আর হারিয়ে পাওয়ার নামই জীবন।
আরও পড়ুন : শোনো কমরেড শোনো…এই সিপিমের ইতিকথা !