অমর ২১ শে : আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…

২১ প্রথম দেখাল অর্গানাইজড ধর্মীয় সুড়সুড়ি নয়, লড়তে হবে চেতনা দিয়ে।
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on telegram
Share on whatsapp
Share on email
Share on reddit
Share on pinterest

সৈয়দ আলি মাসুদ

আজ ২১ ফেব্রুয়ারি। আজ নিজেদের গরিমা স্মরণের দিন। সবার। বাঙালি ও বাঙালের। ভাষার জন্য যে এমন অকাতরে প্রাণ দেওয়া যায়, তা দেখিয়ে গিয়েছেন বাংলাদেশের একঝাঁক তরুণ। এই তরুণদের আবেগ, তাদের জেদ, বাঙালিকে ফিরিয়ে দিয়েছে তাদের অস্মিতা। ভাষা হল মানুষকে সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক তৈরির অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম। সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা চিরকাল এই ভাষাকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছে। ভাষার ভিতর দিয়ে সংস্কৃতি দখলের লড়াই তারা আজও চালিয়ে যাচ্ছে।

ধর্মের নাম করে হিংসা, বহু পুরোনো ইতিহাস। কিন্তু বাঙালি প্রথম দেখাল ভাষা তাদের কাছে ধর্মের থেকে কম কিছু নয়। ধর্মকে বারবার রাজনৌতিক দল ও শাসক দল তার নিজের ধান্দায় কাজে লাগিয়েছে। সে ধারা আজও অব্যাহত। পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ উভয়ের ধর্মীয় পরিচয় এক ছিল। কিন্তু ভাষা ও সংস্কৃতিগত পরিচয় ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

উর্দুভাষীরা নিজেদের বাংলাভাষীদের থেকে ‘সুপিরিয়র’ মনে করতে শুরু করেছিল। নিজেদের তারা বাঙালিদের শাসক বলে ভাবতে শুরু করেছিল। বাঙালিদের অবজ্ঞা করার প্রবণতা তাদের মধ্যে প্রবল হয়ে ধরা দিয়েছিল। বাঙালির সংস্কৃতিকে গিলে খেতে চেষ্টা করছিল তারা। কিন্তু বাঙালি তা হতে দেয়নি। বলা ভালো, পূর্ববঙ্গের বাঙালি তা হতে দেয়নি। কারণ সে দিন পূর্বঙ্গের বাঙালির যে হাল হয়েছিল, আজ সেই অশনি সংকেত পশ্চিম বাংলায় দেখা যাচ্ছে।

রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে পাকিস্তান বাংলাদেশের ওপর তাদের ভাষা ও সংষ্কৃতি চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিল। নয় দিনের পূর্ববঙ্গ সফরে জিন্নাহ ঢাকা ও চট্টগ্রামে কয়েকটি সভায় বক্তৃতা দেন। ঢাকায় প্রথম সভাটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে – যা এখন সোহরাওয়ার্দি উদ্যান।

জিন্নাহ স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে উর্দু – অন্য কোন ভাষা নয়।ইংরেজিতে দেয়া সেই বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, “আমি খুব স্পষ্ট করেই আপনাদের বলছি যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, এবং অন্য কোন ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু।”

মি. জিন্নাহ যেদিন কার্জন হলে ভাষণ দেন – সেদিনই বিকেলে তার সাথে দেখা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটি দল । এ সময় ভাষা নিয়ে তাদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক প্রায় ঝগড়াঝাটির স্তরে পৌঁছে যায়।মি. জিন্নাহকে একটি স্মারকলিপিও দেয় ছাত্রদের দলটি। তাতে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয় এবং কানাডা, বেলজিয়াম ও সুইৎজারল্যান্ডের মত একাধিক রাষ্ট্রভাষা আছে এমন কিছু দেশের উদাহরণ দেয়া হয়।

এই ছাত্র নেতারা অনেকেই ছিলেন মি. জিন্নাহর দল মুসলিম লিগের। কিন্তু ভাষার প্রশ্নে পূর্ব বঙ্গের প্রাদেশিক মুসলিম লিগের একাংশ কেন্দ্রীয় নেতাদের চাইতে ভিন্ন ভূমিকা নিয়েছিল। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাবার্তা শুরু হবার সাথে সাথেই পূর্ব বঙ্গের ছাত্র, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ, বুদ্ধিজীবী আর রাজনীতিবিদরা বুঝেছিলেন যে এটা বাঙালিদের জন্য চরম বিপর্যয় ডেকে আনবে।

তারা বুঝলেন, এর ফলে পাকিস্তানে উর্দুভাষীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিক হবে, বাঙালিরা সরকার ও সামরিক বাহিনীতে চাকরি-বাকরির সুযোগের ক্ষেত্রে উর্দু-জানা জনগোষ্ঠীর তুলনায় পিছিয়ে পড়বেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার ফলে বাঙালি মুসলমানদের উন্নয়ন ও সামাজিক বিকাশের স্বপ্ন সৃষ্টি হয়েছিল – তা চরমভাবে ব্যাহত হবে।

আসলে ২১ ছিল আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। জোর করে একটি ভাষাকে বিশেষ উদ্দেশে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। নিজেদের প্রাণ দিয়ে এই আগ্রাসন রুকে দিয়েছিলেন বাঙালিরা। সব লড়াইয়ে নেতৃত্ব বড় ভূমিকা নেয়। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে । তাদের কয়েকজনকে ইতিহাস জায়গা দিয়েছে। কিন্তু লড়াইটা কয়েকজেনর ছিল না। তবে কিছু ছেলে তাদের চেতনার আলোটা বহু জনের মধ্যে বিস্তার করতে পেরেছিলেন। সে খানেই রফিক, বরকত, জব্বার, শফিকদের গুরুত্ব।

বাংলাদেশে সেদিন সফল হয়েছিল। জয়ী হয়েছিল তারুণ্যের শক্তি। আজ পশ্চিম বাংলায় সেই ছায়া। গোবলয়ের সংস্কিতি ও ভাষাকে কট্টর ধর্মীয় রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে ছড়ানো হচ্ছে। বাংলার সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা হচ্ছে। গোবলয়ের ভাষা ও সংস্কৃতি বাংলার ওপর চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে। বাঙালিকে এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। তা না হলে স্বাধীন ভারতের ইভিএম জয়ী স্বৈরাচারী দল বাংলাকে ছেড়ে কথা বলবে না।

বাংলাদেশ কেবল এক্ষেত্রে বাঙালিদের দিশা দেখিয়েছে তা নয়, তারা সারা বিশ্বকে আলো দিয়েছে। অন্যভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। কিন্তু আজ সেখানেও গণতন্ত্র ও দলতন্ত্রকে চেনা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। শাসকদল ও গণতন্ত্র একাকার। নিজের মত করে বাঁচতে চাইছে বাঙালিরা। একটা সুখী প্রজন্ম তৈরী হয়েছে। দেশের গণতন্ত্রের পরিসরে অন্য দেশের বিমূর্ত ছায়া ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। জিডিপির খবর রাখতে গিয়ে বহু বাঙালি তা ভুলে বসছেন। কিন্তু যারা বিশ্বকে আলো দেখিয়েছে, তাদের জেগে থাকতে হবে। সব রকম আধিপত্যবাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। তবে টিকে থাকবে দুইপারের বাঙালি।

সে কারণেই তো ২১ এর এমন উজ্জাপন। কারণ ২১ প্রথম দেখাল অর্গানাইজড ধর্মীয় সুড়সুড়ি নয়, লড়তে হবে চেতনা দিয়ে। লড়তে হবে নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য। কেবল চওড়া রাস্তা, কিংবা সবুজ ধানের ক্ষেত হলেই হবে না। চেতনা থাকতে হবে সবুজ। তা না হলে উন্নয়নের স্লোগান দিয়ে রাজনৈতিক February 21,দলগুলি মানুষের সুকুমার চেতনাকে দাস বানিয়ে ফেলবে। যা মারাত্মক। সুস্থ অর্থনীতি যতটা জরুরী, ততটাই জরুরী সুস্থ চেতনা। তা না হলে সেই অর্থনীতি ধান্দাবাজদের মুষ্ঠিব্ধ হতে বেশি দিন লাগবে না।

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on telegram
Share on whatsapp
Share on email
Share on reddit
Share on pinterest