Rabindra Jayanti 2021: সংকট কালে রবি ঠাকুর আরো বেশি প্রাসঙ্গিক

জমির উর্বরতা বাড়িয়ে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে কৃষকের উন্নতির কথা তিনি খুবই জোর দিয়ে বলতেন।
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on telegram
Share on whatsapp
Share on email
Share on reddit
Share on pinterest

সংকটকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। তিনি জন্মেছিলেন উনিশ শতকের শেষার্ধে। বেড়ে উঠেছেন বিংশ শতকের প্রথমাংশে। একই সঙ্গে দুটি বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষ দেখেছেন। সভ্যতার সংকটে যেমন উদ্বিগ্ন হয়েছেন, প্রযুক্তির বিকাশে আবার আশাবাদীও হয়েছেন। তরুণদের কাছে ছিল তাঁর বিরাট প্রত্যাশা। সবাইকে শিক্ষা দেওয়ার মধ্যেই তিনি সভ্যতার মহাসড়কে ওঠার রাস্তা খুঁজেছেন। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষায় মানবিক সংযোগ ও বিশ্ববীক্ষার ওপর খুব জোর দিতেন। পূর্ব আর পশ্চিম মিলে মানবিক জ্ঞানভাণ্ডার তৈরি করবে বলে তিনি শান্তিনিকেতনকে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করেছিলেন। অন্যদিকে শিক্ষা যদি জীবনেরই কোনো কাজে না লাগে তাহলে তাকে আবার শিক্ষা বলে কী লাভ? এমনও ভাবতেন। দুই সভ্যতা ও দুই শতকের টানাপড়েনে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ব্যতিব্যস্ত। জলপথেই সারা বিশ্ব ঘুরে ঘুরে দেখেছেন ও জেনেছেন অবিরত। পশ্চিমে তখন শিল্পায়ন ও প্রযুক্তির বিকাশ ঘটছিল দ্রুতলয়ে। বিশ্বক্ষমতা ইউরোপ থেকে আমেরিকার দিকে তখন ধাবমান। অন্যদিকে পুবের আকাশে স্বাধীনতা ও সমাজসংস্কারের আকাঙ্ক্ষা প্রস্ফুটিত হওয়ার আশায় ছটফট করছিল। রেল, বিদ্যুৎ ও প্রযুক্তির ছোঁয়া পুবেও লেগেছে। এরই মধ্যে বিংশ শতকেই দু-দুটো মহাযুদ্ধ মানবসভ্যতায় নয়া বেদনা ও সংশয় সৃষ্টি করেছে। যুদ্ধবীজ জাতীয়তাবাদ কবিকে ক্ষুব্ধ করেছে।

তবে এত উথালপাথালের মধ্যেও তিনি মাটিতে পা রেখে আকাশ থেকে নির্মল বায়ুর শ্বাস নিতে দ্বিধা করেননি। কিশোরকালেই জমিদারি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি পূর্ব বাংলার মানুষের দুঃখ-বঞ্চনা খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর চোখে পল্লী প্রকৃতি এক অপরূপ রূপেও ধরা পড়েছিল। এরই মধ্যে তিনি বছর দেড়েক ইংল্যান্ডে থেকেছেন পড়াশোনার জন্য। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক সে শিক্ষার সুযোগ তাঁকে আন্দোলিত না করলেও পাশ্চাত্যের শিক্ষাব্যবস্থার উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং তরুণ মনে সৃজনশীলতার উদ্দীপনা তৈরির বিষয়গুলো ঠিকই মনে দাগ কেটেছিল। এমন বহুমুখী অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি পূর্ব বাংলার কৃষক প্রজাদের আধুনিক কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সুযোগ করে দেওয়ার নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। অন্যান্য জমিদারের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন ছিল তাঁর চলার পথ। তাই স্বদেশি সমাজ গড়ার আশায় কত লেখা ও বক্তৃতাই না তিনি দিয়ে গেছেন। তাঁর চিঠিগুলোতেও সমাজসংস্কারের সুপ্ত বাসনা ফুটে উঠেছে। এসব কথা মনে হয় তাঁর সময়ের চেয়ে শত বছর এগিয়ে। তা-ও আজও তাঁর লেখা, বলা, সংগীত, নৃত্য, চিত্রকলা ও গ্রামীণ উন্নয়ন ভাবনা এতটা প্রাসঙ্গিক মনে হয়। উন্নয়ন কবি। অর্থনীতি তাঁর বিষয় নয়। তবু উন্নয়নের যে সংজ্ঞা তিনি তাঁর লেখা ‘বৈতায়নিকের চিঠি’তে দিয়ে গেছেন তা আজকের দিনের টেকসই উন্নয়ন ধারণার পূর্বসূরি বললে মোটেও ভুল হবে না। তিনি লিখেছেন, ‘… যে জাতি উন্নতির পথে বেড়ে চলেছে তার একটা লক্ষণ এই যে, ক্রমশই সে জাতির প্রত্যেক বিভাগের এবং প্রত্যেক ব্যক্তির অকিঞ্চিৎকরতা চলে যাচ্ছে। যথাসম্ভব তাদের সকলেই মনুষ্যত্বের পুরো গৌরব দাবি করার অধিকার পাচ্ছে। এই জন্যেই সেখানে মানুষ ভাবছে কী করলে সেখানকার প্রত্যেকেই ভদ্র বাসায় বাস করবে, ভদ্রোচিত শিক্ষা পাবে, ভালো খাবে, ভালো পরবে, রোগের হাত থেকে বাঁচতে এবং যথেষ্ট অবকাশ ও স্বাতন্ত্র্য লাভ করবে।’

এই ভাবনাগুলো যখন রবীন্দ্রনাথ ভাবছিলেন তখন পশ্চিমা দুনিয়া বহুমাত্রিক সব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। বিশ্বায়ন, প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ, যোগাযোগ ও পরিবহনের অসামান্য উন্নতির সুফল তারা পাচ্ছিল। অন্যদিকে শ্রমিকদের অধিকার সচেতনতাও বাড়ছিল। পরিবেশের ক্ষয়ক্ষতি নিয়েও পশ্চিমের পণ্ডিতজনরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। পাশাপাশি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সামাজিক গণতন্ত্র, সাম্যবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল।

ভারতবর্ষে, বিশেষ করে বাংলায়ও এসব ভাবনার ঢেউ আছড়ে পড়ছিল। বাঙালির পুনর্জাগরণে স্বাধীনতা ও উন্নয়ন ভাবনা জোর হাওয়া দিচ্ছিল। এখানেও রেল, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বেশ জোরেশোরেই চলছিল। বাংলার জমি বরাবরই উর্বর ছিল। তা সত্ত্বেও বন্যা, খরা এখানেও দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে দেখা দিত। আর ঔপনিবেশিক একপেশে শাসনব্যবস্থার চাপ তো ছিলই। জমিদারি ব্যবস্থার অমানবিকতা ও সংস্কারহীনতা গরিব কৃষকদের জন্য অসহনীয় বোঝা হিসেবে বিরাজ করছিল। নগরে জন্মেও খুব কাছে থেকে দেখা পূর্ব বাংলার গ্রামীণ মানুষগুলোর দুঃখ-কষ্ট রবীন্দ্রনাথকে ব্যথিত করত। তাদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য তাই তিনি নানামুখী সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পতিসর, শাহজাদপুর, শিলাইদহে তাঁর সেসব উদ্যোগের নানা চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে।

আরও পড়ুন: রবি ঠাকুর ও কাদম্বরী দেবীর গল্প এবার ছোটপর্দায়, জেনে নিন ‘রবির নতুন বৌঠান’ সম্পর্কে বিস্তারিত

রবীন্দ্রনাথের সময় সারা বিশ্বে ছিল ১০০ কোটি মানুষ। এখন তা বেড়ে ৭০০ কোটিরও বেশি হয়ে গেছে। বাড়তি এই বিপুল জনগোষ্ঠীর চাপ এই পৃথিবী অনেক সময় বহন করে উঠতে পারছে না। মানুষের সীমাহীন লোভ প্রকৃতির ওপর নানা মাত্রিক চাপ সৃষ্টি করছে। প্রকৃতির দানকে মানুষ উপেক্ষা করে তার ওপর জুলুম করছে। তাই প্রকৃতি বিগড়ে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের যে চ্যালেঞ্জ আমরা এখন মোকাবেলা করছি তা প্রকৃতির এই অসন্তুষ্টির কারণেই। প্রকৃতির অসহিষ্ণুতার প্রতিফলন আমরা এখন দেখছি করোনাভাইরাস নামের এই ক্ষুদ্র কণার আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত সারা বিশ্বেই। এই যে আকাশচুম্বী দালানকোঠা, শিল্পায়নের ধুম, নগরায়ণের বিশ্রী রূপ, প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ, বিশ্বায়নের অপ্রতিরোধ্য গতি—পুরো সমাজকে কতিপয়ের পোয়াবারো করে ফেলেছে। কিন্তু চলমান এই মহামারি উন্নয়নের এত সব প্রাপ্তিকে অর্থহীন করে ফেলেছে। আজ মানুষ মানুষের কাছে গিয়ে দাঁড়াতে অক্ষম। টাকা থাকলেও যেখানে খুশি সেখানে যেতে অপারগ মানুষ। রবীন্দ্রনাথ এমনটি চাননি। তিনি শুধু নগরের নয়, গ্রামীণ সমাজ ও অর্থনীতির উন্নতি চেয়েছিলেন। তিনি অমানবিক বৈষম্যপূর্ণ, কতিপয়ের উন্নয়নের বিরুদ্ধে ছিলেন। সামাজিক বন্ধনকে প্রাণের লক্ষণ মনে করে তিনি সবার জন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে মনোযোগী হয়েছিলেন।

ক্ষুধাকে নিবারণের ওপর তিনি খুব জোর দিয়েছিলেন। জমির উর্বরতা বাড়িয়ে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে কৃষকের উন্নতির কথা তিনি খুবই জোর দিয়ে বলতেন। পাশাপাশি অকৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য তিনি শ্রীনিকেতন গড়ে তুলেছিলেন। জীবনের জন্য শিক্ষার ওপর জোর দিতেন রবীন্দ্রনাথ। মাতৃভাষায় শিক্ষার পক্ষে ছিলেন তিনি। যা-ই শিখি না কেন, তা নারী ও পুরুষের সবার জন্য সমান তালে হতে হবে। নারীরা ঘর থেকে বের হয়ে শিক্ষার সুযোগ নিচ্ছে দেখে তিনি খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন। তবে মনের পর্দা দূর করার জন্যও আধুনিক নারীশিক্ষার কথা তিনি খুব করে বলতেন। ‘পশ্চাতে রাখিছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে’ বলে বৈষম্য দূর করার ওপর জোর দিতেন। প্রতিটি গ্রাম এমন করে উন্নত করতে হবে যে তা যেন হয় স্বয়ংসম্পূর্ণ। সমাজ যেমন যুগে যুগে নিজেই স্বশাসিতভাবে চলে এসেছে, গ্রামগুলোকেও তিনি তেমন বিকেন্দ্রায়িত স্বশাসিত করার জন্য হিতৈষী সভা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গ্রামে গ্রামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গ্রামে গ্রামে পুকুর কেটে জলের কষ্ট দূর করার উদ্যোগ নিয়েছেন।

বিশ্বকবি ‘আমাদের’ ও ‘তাহাদের’ সভ্যতায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর মতে, শিল্প সবার জন্য। গ্রামের মানুষের মধ্যেও শিল্প-সংস্কৃতির নানা উপায় তিনি খুঁজে পেতেন। তাঁর কাছে জীবন ও শিল্প আলাদা বিষয় ছিল না। লালন শাহের সংস্পর্শে এসে রবীন্দ্রনাথ বৃহৎ সংস্কৃতির সন্ধান পান। তাঁর গানে, নৃত্যে—পূর্ব-পশ্চিমের সুর ও তাল খুঁজে পেতে তাই অসুবিধা হয়নি। গ্রামের বাউলগান, যাত্রা এবং নগরের নৃত্যনাট্য তাঁর কাছে সমান গুরুত্ব বহন করত।

তিনি মনে করতেন মানুষের আনন্দ নিজের কিছু প্রাপ্তিতে নয়। সমগ্র সমাজ ও মানবতার জন্য কাজই আসল কাজ। মানবধর্মই আসল ধর্ম। সেই দৃষ্টিভঙ্গিতেই বলতে পারি, বর্তমানের এই করোনা সংকটকালে সারা বিশ্বকে একযোগে এই পৃথিবীকে বাঁচানোর চিন্তা করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইচ্ছা করলেই সারা বিশ্বের মানুষের জন্য টিকা উৎপাদনের দুয়ার খুলে দিতে পারে। অন্যান্য উন্নত দেশও গরিব দেশগুলোর জন্য এগিয়ে আসতে পারে। কিন্তু সেই সর্বজনীনভাবে বিশ্বের সংকটকে নিজের সংকট হিসেবে এক রবীন্দ্রনাথই দেখতে পারতেন। তাই মৃত্যুর আগমুহূর্তেও সভ্যতার সংকট নিয়ে তিনি ভেবেছেন। বিশ্বকে আরো মানবিক ও পারস্পরিক বন্ধনে বাঁধতে চেয়েছিলেন। সে কারণেই বলা যায়, আজকের এই সংকটকালেও রবীন্দ্রনাথ খুবই প্রাসঙ্গিক।

আরও পড়ুন: Rabindra Jayanti 2021: মহামারি রুখতে পথে নেমেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, হারিয়েছেন স্বজন

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on telegram
Share on whatsapp
Share on email
Share on reddit
Share on pinterest