ইংরেজদের কাছে বহুবার ক্ষমা প্রার্থনা, নিজেই নিজেকে দিয়েছিলেন ‘বীর’ উপাধি – জন্মদিনে জানুন সাভারকারের বিতর্কিত জীবন সম্পর্কে

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on telegram
Share on whatsapp
Share on email
Share on reddit
Share on pinterest

বিনায়ক দামোদর সাভারকর। বিজেপির হিন্দুত্বের আইডিওলজির জন্মদাতা। বিজেপির বিদ্বেষমূলক, বিভেদমূলক আদর্শের আঁতুড়ঘর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং তৎকালীন ভারতের আরেকটি সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণমনা রাজনৈতিক-ধার্মিক দল, হিন্দু মহাসভার দীর্ঘকালের সভাপতি।

আমরা অনেকেই জানি, আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সেলুলার জেলে দীর্ঘ দশ বছর তিনি বন্দী ছিলেন, এবং আজ পোর্ট ব্লেয়ারের এয়ারপোর্টটি তাঁরই নামে নামাঙ্কিত। বীর সাভারকর এয়ারপোর্ট। কিন্তু কী রকম বীর ছিলেন তিনি? কত বীরত্বের কাহিনিগাথার জন্ম দিয়েছেন তিনি? আমরা নেতাজীর বীরত্বের কাহিনি পড়েছি, পড়েছি বিনয়-বাদল-দীনেশের গল্প, জেনেছি সর্দার ভগৎ সিংয়ের আত্মবলিদানের কাহিনি, অগ্নিযুগের আরও অসংখ্য বীর বিপ্লবীর বীরত্বের গাথা আমরা পড়ে এসেছি আমাদের স্কুলজীবনের ইতিহাস বইতে, অন্যান্য বইতে। কিন্তু সাভারকরের বীরত্ব? তা নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন থেকে গিয়েছে ইতিহাসবিদদের কাছে।

১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের আদর্শেই, শুরুতে তিনি, সশস্ত্র আন্দোলনে বিশ্বাস করতেন। লন্ডনে বসে ১৯০৫-এর রুশ-বিপ্লবের আগুন তাকে উদ্দীপ্ত করে। তাঁর শিষ্য মদনলাল ধিংড়া ১৯০৯-এ খোদ ইংল্যান্ডে বসেই কার্জন ওয়াইলিকে খুন করেন। পর পর আরও নানাবিধ বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের জন্য ১৯১০-এ ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। তারপর কালাপানি পার করে পরের বছর আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলে পাঠিয়ে দেয়। এর পরেই শুরু হল বীর সাভারকরের জীবনের দ্বিতীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। কুখ্যাত মুচলেকাপর্ব।

জেলের কঠিন জীবনযাপন কাটাবার মাসখানেকের মধ্যেই, ১৯১১ সালে সাভারকর তাঁর প্রথম ক্ষমাভিক্ষা বা মার্সি পিটিশনেরর চিঠিটি লেখেন ইংরেজ সরকারের উদ্দেশ্যে, যেটি সাথে সাথে নাকচ হয়। দ্বিতীয় মার্সি পিটিশন তিনি লিখে পাঠান ১৯১৩ সালে, যেখানে দেখা যাচ্ছে তিনি তিক্ত অনুযোগ করছেন তাঁর পার্টির অন্যান্য সহবন্দীরা তাঁর থেকে বেশি সুযোগসুবিধা পাচ্ছেন বলেঃ

“১৯১১ সালের জুন মাসে আমি যখন প্রথম এখানে আসি, আমার পার্টির অন্যান্য অভিযুক্তদের সাথে আমাকে মুখ্য কমিশনারের অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাকে “ডি” ক্লাসের আওতাভুক্ত করা হয় – ডি মানে ডেঞ্জারাস প্রিজনার, কিন্তু আমার সঙ্গের অন্যান্য অভিযুক্তদের ডি ক্লাসের আওতায় ফেলা হয় নি। এর পরে টানা ছ মাস আমাকে একলা নির্জন কারাবাসে বাধ্য করা হয়, আর কাউকে কিন্তু এই সলিটারি কনফাইনমেন্ট দেওয়া হয় নি। যদিও পুরো সময়কাল ধরেই আমার আচরণ অত্যন্ত ভালো ছিল, কিন্তু তবুও সেই ছ মাসের সলিটারি কনফাইনমেন্টের শেষে আমাকে জেল থেকে ছাড়া হয় নি, যদিও আমার সহবন্দীরা ছাড়া পেয়ে গেছিল।

…যারা অল্প মেয়াদের কয়েদী, তাদের কথা আলাদা, কিন্তু স্যার, আমার কপালে তো পঞ্চাশ বছরের সাজা লেখা রয়েছে! নৃশংসতম অপরাধী এখানে যেটুকু সুযোগ সুবিধে পায়, সেটুকুও যদি আমার জন্য বরাদ্দ না হয়, তবে আমি এই সুদীর্ঘ সময় এই বদ্ধ কুঠুরিতে কাটাবার মত মনের জোর কোথা থেকে জোটাতে পারব?”

অতঃপর, ১৯০৬-১৯০৭ সালের ভারতের দিশাহীন অবস্থার বশেই যে তিনি পথ ভুল করে বিপ্লবের পন্থা বেছে নিয়েছিলেন, সে কথা স্বীকার করে তিনি ১৯১৩ সালের ১৪ই নভেম্বরের সেই পিটিশনে ব্রিটিশ সরকারকে আশ্বস্ত করেন যে তিনি জ্ঞানত সেই পথ পরিবর্তন করেছেন। “সরকার বাহাদুর যদি কৃপাবশত আমাকে ক্ষমা করেন এবং মুক্তি দেন,” তিনি লিখেছেন, “আমি কেবল এবং কেবলমাত্র ব্রিটিশ সরকারবাহাদুরের অনুগত, আজ্ঞাবহ সর্বশ্রেষ্ঠ সমর্থক হয়ে থাকব।”

এ ছাড়াও, তাঁর ক্ষমাভিক্ষার চিঠিতে তিনি এমন কিছু অফার করেন যা সেই সময়ের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা স্বপ্নেও ভাবতে পারত না, “সরকারের বশ্যতাস্বীকার করে আমার মনে যে পরিবর্তন এসেছে, তার বলে আমি একদা ভারতে এবং বিদেশে আমার যারা অনুগামী ছিল, তাদেরকেও আমি ভ্রান্ত পথ থেকে ফিরিয়ে এনে সঠিক পথে পরিচালনা করতে পারি। আমার সামর্থ্য এবং ক্ষমতায় যতখানি সম্ভব, ততখানি ব্যবহার করে আমি সরকার বাহাদুরের খিদমতগার হয়ে থাকতে চাই, কারণ আমি সজ্ঞানে আমার মধ্যে এই বদল ঘটাচ্ছি। মহামহিম সরকার বাহাদুর যেন দয়া করে আমাকে ক্ষমা করেন, মহামহিম সরকার বাহাদুর ছাড়া আর কে এক দুষ্ট, বিগড়ে যাওয়া সন্তানকে ফিরিয়ে আনবে তার পিতার ঘরে?” [“my conversion to the constitutional line would bring back all those misled young men in India and abroad who were once looking up to me as their guide. I am ready to serve the Government in any capacity they like, for as my conversion is conscientious..The Mighty alone can afford to be merciful and therefore where else can the prodigal son return but to the paternal doors of the Government?”]

৩০শে মার্চ, ১৯২০ সালে তাঁর চতুর্থ মার্সি পিটিশনে সাভারকর লেখেন যে উত্তর দিক থেকে “এশিয়ার রক্তপিপাসু জনজাতির” আক্রমণ ঘটতে পারে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ওপর, যারা আপাতদৃষ্টিতে সরকারের “বন্ধু” সেজে আছে, এবং তিনি নিশ্চিত যে এই সময়ে তাঁর মত “যে কোনও বুদ্ধিমান ভারতপ্রেমিক এই সময়ে প্রাণমন দিয়ে, ভারতের স্বার্থেই ব্রিটিশ সরকারের পাশে এসে দাঁড়াবে এবং সব রকমের সহযোগিতা করবে।”

এই পিটিশনে সাভারকর লেখেন, “এই সুমহান সাম্রাজ্যের মহানতার ছায়ার নিচে আমার হৃদয় তার প্রতি অনুগত, অনুরক্ত হয়ে ওঠে। সরকার যদি আরও বেশি করে নিশ্চিত হতে চান আমার এবং আমার ভাইয়ের ব্যাপারে, তবে আমরা সম্পূর্ণভাবে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে রাজি আছি যে সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া যে কোনও যুক্তিগ্রাহ্য সময়সীমা পর্যন্ত আমরা কোনওরকম রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে নিজেদের যুক্ত রাখব না … অথবা অন্য যে কোনও প্রতিশ্রুতি যা সরকার বাহাদুর আমাদের কাছ থেকে লিখিয়ে নিতে চান, যেমন, নির্দিষ্ট একটি রাজ্যের চৌহদ্দির বাইরে কখনও না বেরনো, অথবা মুক্তির পর আমাদের যে কোনওরকম যাতায়াতের সম্পূর্ণ খবরাখবর যে কোনও সময়কাল ধরে নিয়মিত পুলিশের কাছে জানানো – সরকারের ইচ্ছেমত যে কোনওরকম শর্ত, সর্বতোভাবে, আমি ও আমার ভাই, দেশের শান্তি ও নিরাপত্তার খাতিরে সানন্দে মেনে নিতে রাজি আছি।”

অবশেষে, দশ বছর সেলুলার জেলে কাটাবার পর এবং একাধিক ক্ষমাভিক্ষার চিঠি বা মার্সি পিটিশন লিখে ওঠার পর, সাভারকর এবং তাঁর ভাই, ১৯২১ সালে রত্নগিরির একটি জেলে স্থানান্তরিত হন, এবং রত্নগিরি জেলার বাইরে কখনও পা ফেলবেন না, আর, জীবনে কখনও কোনও রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সাথে নিজেকে যুক্ত করবেন না – এই শর্তে রাজি হবার পর ১৯২৪ সালে অবশেষে তাঁরা মুক্তি পান, দুজনেই। এই নিষেধাজ্ঞার শর্ত তাঁদের ওপর থেকে তোলা হয় ১৯৩৭ সালে।

আরও পড়ুন : World Book Day: আরও বেশি যত্নে থাকুক প্রিয় বইগুলো

এক হেরে যাওয়া মানুষের আত্মপ্রচারের গপ্পো

এখানে তর্ক উঠতেই পারে যে, ১৯২৪ সালে তাঁর এই যে শর্তগুলিতে রাজি হওয়া, এবং ব্রিটিশ সরকারের প্রতি শর্তহীন ভালোবাসা এবং আনুগত্য দেখানো, সরকারের হয়ে যে কোনও রকম কাজ করতে ইচ্ছুক হওয়া ইত্যাদি; এগুলো মুক্তির জন্য এক ধরণের কূটকৌশল হতেই পারে – শিবাজী যেমন করেছিলেন – শর্তাবলী মেনে জেলের বাইরে গিয়ে আবার তাঁর স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। হ্যাঁ, হতেই পারে, তবে ইতিহাস কিন্তু সাভারকরকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে মনে রাখে নি, মনে রেখেছে শর্ত মেনে চলা এক অনুগত ব্রিটিশসেবক হিসেবেই, যিনি কোনওভাবেই জেলের বাইরে গিয়ে তাঁর ওপর ব্রিটিশ সরকারের আরোপ করা শর্তগুলির একটিও ভাঙেন নি, যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে সেগুলো মেনে চলেছেন।

সাভারকার কথা রেখেছিলেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করতে শুরু করেন। ঐতিহাসিকদের থেকে জানা যায়, ১৯৪১ সালে বিশ্বযুদ্ধের আবহাওয়ায় নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু যখন আজাদ হিন্দ বাহিনী তৈরি করছেন, তখন ‘বীর’ সাভারকর তাঁর অনুগামীদের পরামর্শ দেন যে , এই মুহূর্তে বাংলা ও আসামের হিন্দুদের উচিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নাম লেখানো। এমন আনুগত্যের পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কমান্ডার সাভারকরের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন।

প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়, এহেন সুবাধ্য নাগরিকটি “বীর” উপাধি কেমন করে পেলেন?

জনৈক চিত্রগুপ্তের লেখা লাইফ অফ ব্যারিস্টার সাভারকর নামে একটি বই, সাভারকরের ওপর লেখা প্রথম জীবনীমূলক বই। ১৯২৬ সালে এটি প্রকাশিত হয়। এই বইতে সাভারকরকে এক সাহসী বীর নায়ক হিসেবে দেখানো হয়। এবং সাভারকরের মৃত্যুর দুই দশক পরে, যখন সাভারকরের লেখাপত্রের অফিশিয়াল প্রকাশক বীর সাভারকর ফাউন্ডেশন ১৯৮৭ সালে এই বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত করে, তখন ফাউন্ডেশনের সম্পাদক রবীন্দ্র রামদাস জানান, বইটির লেখক, “চিত্রগুপ্ত, স্বয়ং সাভারকর ব্যতীত আর কেউ নয়”।

এই আত্মজীবনীতে, থুড়ি, চিত্রগুপ্ত-লিখিত জীবনীতে, সাভারকর পাঠকদের উদ্দেশ্যে জানান যেঃ “সাভারকর আজন্ম এক সাহসী নায়ক, ফলাফলের তোয়াক্কা না করেই তিনি যে কোনও কাজের দায়িত্ব নিয়ে তা সম্পূর্ণ করতে পিছপা হতেন না। সরকারের যে নিয়ম বা আইন তাঁর কাছে সঠিক বা বেঠিকভাবে অন্যায় মনে হত, তৎক্ষণাৎ সেই অশুভ নিয়মকে সমাজের বুক থেকে চিরতরে মুছে ফেলার জন্য তিনি যে কোনও পন্থা অবলম্বন করতে দ্বিধা বোধ করতেন না।”

শব্দের খেলা না খেলেই, শালীনতার তোয়াক্কা না করেই সমস্ত সম্ভাব্য বিশেষণসমূহ ব্যবহার করে সাভারকর এই বইতে লিখেছেন যে, সাভারকর “অজস্র চোখে পড়ার মত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন, যেমন, চমকে দেবার মত উপস্থিত বুদ্ধি, অসীম সাহস, অদম্য আত্মবিশ্বাস যা তাঁকে জীবনে অনেক মহান ব্রত সম্পন্ন করতে সাহায্য করেছিল। তাঁর সাহস এবং উপস্থিত-বুদ্ধির অকুণ্ঠ প্রশংসা না করে থাকা যায় না।”

সাধারণভাবে, ভদ্রসমাজে, একজন প্রাক্তন বিপ্লবী জেল থেকে কোনওমতে ছাড়া পেয়ে যখন ছদ্মনামে ঝুড়ি-ঝুড়ি মিথ্যে কথা লিখে আত্মপ্রচারে রত হয়, তখন অন্যরা ভদ্রজনোজিত কুণ্ঠা ও লজ্জায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে না। এবং সত্যিই, এমন কারুর পক্ষেই, যিনি আন্দামানের সেই কুখ্যাত জেলে দীর্ঘদিন নরকযন্ত্রণা ভোগ করেন নি, সাভারকরকে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে স্বাধীনতার আন্দোলনে আবার যুক্ত না হবার জন্য তিরস্কার করা সম্ভব ছিল না।

কিন্তু তাঁর যে আদর্শ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বার বার সাম্প্রদায়িকতার বিভেদরেখার পথ ধরে বারবার বিপথে ঠেলে দিয়েছে, এবং এই আন্দোলনকে শক্ত হাতে দমন করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ব্রিটিশ সরকারকে তাঁর যে লাগাতার নিঃশর্ত সক্রিয় সাহায্য, দেশের স্বাধীনতার প্রতি এগুলো এক রকমের বিশ্বাসঘাতকতাই, একজন “দেশভক্ত” বা “জাতীয়তাবাদীর” তরফে যা ক্ষমা করা যথেষ্ট কঠিন।

আরও পড়ুন : Kazi Nazrul Islam’s 122nd birth anniversary: ভুল নয়, কাজী নজরুল ইসলামকে ভাগ করার চেষ্টা ছিল আমাদের পাপ

 

 

 

 

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on telegram
Share on whatsapp
Share on email
Share on reddit
Share on pinterest