সৈয়দ আলি মাসুদ
আর্থিক সংকট শুরু হয়েছে বিশ্ব জুড়ে। সব রাষ্ট্র প্রধানই বুঝছেন গতিক ভালো নয়। কিন্তু সেই অবস্থা মোকাবিলায় কারও তেমন আগ্রহ নেই। কিভাবে আরও বেশি দিন কুর্সিতে থাকা যায় সেটাই মোদ্দা কথা। তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। গণতন্ত্র ব্যাপারটা এদেশের লকডাউনের মতই হয়ে গিয়েছে। বাইরে থেকে যাকে গণতন্ত্র বলে ভ্রম হচ্ছে তা আসলে স্বৈরতন্ত্র। কোনও রাষ্ট্রনেতাই দেশবাসীর কাছে জবাব দিতে রাজি নন। প্রতিটি দেশের নাগরিক ক্রমশ প্রজায় পরিণত হচ্ছে। এক নকশার অনুশীলন কমবেশি সব দেশই করছে।
মানুষের রুজি, রুটি কর্ম সংস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই, বিরোধীদের দায়ী করা হচ্ছে। একটা ‘ছদ্ম জাতীয়তাবাদের ‘ গান শোনানো হচ্ছে। ভাবছেন বিশেষ কাউকে নিশান করে কথাটি বলছি। তা কিন্তু নয়। এটা সার্বিক ছবি। পুতিন থেকে ট্রাম্প। জিনপিং থেকে কিম সকলে এই চেষ্টা করছেন। এমনকি পড়শী নেপাল এবং বাংলাদেশের দিকে নজর করেও সেই একই ছবি।
সকলে চাইছে বিরোধী মুক্ত রাজনীতি। বিরোধীদের কোমর ভেঙে দিতে হবে। অথচ সরকারের ব্যার্থতার দায় তাদের ঘাড়েই চাপাতে হবে। কিছু শত্রু তৈরী করতে হবে। দেশবাসীর কাছে একটা সাসপেন্স জিইয়ে রাখতে হবে। একটা যুদ্ধ যুদ্ধ থ্রিল তৈরী করতে হবে। আর ঘন ঘন বলতে ‘আমরা সেরা।’ পড়শিরা শত্রুতা করছে। আমাদের শেষ করে দিতে চাইছে। তাই সেনাকে সামনে আনতে হবে। যখন আপনার প্রাণ যাই যাই অবস্থা, তখন কি আপনি চাকরি চাইবেন? নিশ্চয় না। বরং রাষ্ট্র নেতার পিছনে দাঁড়াবেন, শত্রুর হাত থেকে পরিত্রান পেতে। এটি গ্লোবাল রাজনীতিতে একপ্রকার রেডিমেড ফর্মুলা।
অতি নিপুণভাবে ধর্মকে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে। ইমরান খান কিংবা এরদোগানও এই কৌশলই গ্রহণ করছেন। সত্যি কথা বলতে কি গোটা বিশ্ব বর্তমানে সবথেকে বেশি ভুগছে নেতৃত্ব সংকটে। এই সংকট করোনার থেকেও ভয়াবহ। বলার মত কোনও রাষ্ট্র নেতা নেই। যারা রয়েছেন তারা গণতন্ত্রের মূল্য দিতে জানেন না। এক্ষত্রে কোনও একজন রাষ্ট্র নেতার উঠে আসার গল্প বললেই বাকিদের সঙ্গে তা হুবহু মিলে যাবে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের কথায় ধরুন না। দুর্নীতিতে অভিযুক্ত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেৎসিনকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসেন পুতিন। তিনি অভিযুক্ত ইয়েলেৎসিনকে জেলে না দিয়ে পথ থেকে হঠিয়ে দেন। তিনি তার কাছে নাকি প্রতিশ্রুতি আদায় করিয়ে নিয়েছিলেন যে আর ইয়েলেৎসিন রাজনীতিতে আসবেন না। ১৯৯১-১৯৯৯ পর্যন্ত ইয়েলেৎসিন ক্ষমতায় ছিলেন। তাকে সরানোর পর পুতিন ধীরে ধীরে সব বিরোধীদের পথ থেকে সরিয়ে দেন।
এমনিতে রাশিয়াতে কোনও কালেই মিডিয়ার স্বাধীনতা ছিল না।তাও যে কটি মিডিয়া প্রশ্ন করত, তাদেরও তিনি শেষ করে দেন। বহু নামি সাংবাদিকের খোঁজ পাওয়া যায়নি। এরপর দেশের লোকের কাছে তিনি দেশপ্রেম ফেরি করতে শুরু করেন। তাদের মাথায় ঢোকান তিনি আর দেশ সমার্থক। এই একটি জিনসের মার্কেট সবসময়। যারা দেশ এবং সমাজ নিয়ে কথা বলে তেমন একটা শ্রেণীর রুজি -রুটির বন্দোবস্ত করে তিনি তাদের মুখবন্ধ করে দেন। তাহলে একদিকে বিরোধী নেই, মিডিয়া নেই, মধ্যবিত্ত নেই। ফলে পুতিনকে প্রশ্ন করার কেউ নেই।
তাঁর বর্তমান কৌশল হল কুর্সিতে থেকে যাওয়া। জিনপিং যেটা আগেই করেছেন। পুতিন ইলেকটোরাল ডিক্টেটরশিপ শুরু করলেন। তিনি দাবি করেছেন রাশিয়ার ৭৮ শতাংশ জনগণই নাকি তাকে চায়। প্রাক্তন কেজিবি প্রধান যে এটা প্রভাব খাটিয়ে করেছেন তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। নিয়ম বদলে ২০৩৬ পর্যন্ত কুর্সিতে থাকবেন তিনি। অমিত শাহ একবার বলেছিলেন ২০১৯ এর লোকসভা ভোট জিতলে বিজেপি থাকবে আরও ৫০ বছর। পুতিন দেশবাসীর সামনে সর্বদা সামনে রেখেছেন দেশপ্রেমকে। দেশপ্রেমের স্লোগান দিয়ে তিনি নির্বিচারে চেচনিয়ার শিশু, মহিলা সহ সাধারণ মানুষকে খুন করেছেন। তাদের জঙ্গি বলে দেগে দেওয়া হয়েছে। চেচেনদের অপরাধ রাশিয়ার সঙ্গে থাকেত না চেয়ে তারা স্বাধীনভাবে থাকতে চেয়েছিল। চেচেন জঙ্গিদের নাম করে পুতিনের সেনা, স্কুলে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে শিশুদের হত্যা করেছিল। ঠিকই ধরেছেন চেচনিয়ার এই অধিবাসীরা বেশিরভাগই মুসলিম। কি হল, মিল খুঁজে পাচ্ছেন নাকি?
সমস্ত চরিত্র বাস্তব। এদেশের রাষ্ট্রনেতার সঙ্গে মিল পাওয়া গেলে তা অবশ্য কাকতালীয় !