সৈয়দ আলি মাসুদ
মানুষ ভেড়ার পালের মত। যার পোশাকি নাম ‘ট্রেন্ড’। বুদ্ধি দিয়ে ভাবার লোক খুব কম। প্রচারে ভেসে যাওয়ার লোক অগুনতি। সে কারণেই ফি নির্বাচনেই মিমকে ‘ভোট কাটুয়া’ বলে তার বাপান্ত করতে লেগে পরে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ পক্ষপাতদুষ্ট জনগনের একাংশ।
যারা মিমকে ভোট কাটুয়া হিসাবে দেখে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক পক্ষপাত রয়েছে। হয় তারা সিপিএমের ভোটার। ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আওড়ে আসলে মুসলমান ভোট পেতে চাইছে। তা না হলে ‘বিলুপ্তপ্রায় কংগ্রেস’। সিদ্ধার্থ রায়ের জমানায় মুসলিমদের কত শতাংশ চাকরি ছিল সে কাসুন্দি ঘাঁটবে তারা । চাইবে মুসলিমরা আবেগে কংগ্রেসকে ভোট দিক। অথচ নিজেরা ঠিক করতে পারবে না,একেবারে বিপরীত আদর্শের সিপিএমের সঙ্গে জোট করা ঠিক হবে, নাকি ভুল।
বাকি রইল দিদিমনির দল। ইমাম ভাতা এবং ভুল টাইমিংয়ে ‘খোদা-হাফেজ ইনশাআল্লাহ’ ও মাথায় কাপড় দিয়ে মোনাজাতের ভঙ্গি করে তিনি বুঝিয়েছেন মুসলিম ভোট তাঁর চায়। বিজেপির মত দলও বাংলায় মুসলিম ভোট পাবার লোভ সামলাতে পারে না। মোদী বাবু মুসলিমদের জন্য কি কি করেছেন তার ফিরিস্তি বের করে তারা । যত দোষ মিমের !
আরও পড়ুন : সন্ধেতেই শেষকৃত্য, রবীন্দ্রসদনে শেষশ্রদ্ধায় শায়িত থাকবে কিংবদন্তী শিল্পীর মরদেহ
বিশেষ রাজনৈতিক দলগুলির চশমা দিয়ে না দেখলে আপনার কাছেও স্পষ্ট হবে যে বিহারে মিম বিশেষ ফ্যাক্টর হয়নি। বেশিরভাগটাই প্রচার। আর যদি মিম ফ্যাক্টরও হয়ে থাকে, তাহলেই বা কি? মনে রাখতে মিম একটি রাজনৈতিক দল। কে কোথায় তারা জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে , এটা দেখা তার কাজ নয়। যদি কেউ মনে করে মিম মুসলিম ভোট কেটে দেবে, তাতে সমস্যাই বা কি। মুসলমনাদের নিয়ে বাকি দলগুলোর রাজনীতি করার অধিকার থাকলে মিমের থাকবে না কেন? তারা অপরাধ কোথায়?
মিমের বিরুদ্ধে মুখ খোলার মত বাস্তব কোনও জায়গায় নেই। বরং বাকি দলগুলো সম্পর্কে আপনি বলতে পারেন। বাংলা একসময় কংগ্রেস শাসন দেখেছে। সিপিএমের শাসনও দেখেছে। তাদের সময় মুসলিম কিংবা হিন্দু কারও সোনার দিন ছিল না। সরকারি চাকরিতে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব মারাত্মকভাবে কমেছিল। তৃণমূল জামানতে যে সে অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়েছে তা নয়।
সিপিএম আমলে বহু মুসলিম নিজের সম্প্রদায়গত পরিচয় প্রকাশ্যে আনতে শঙ্কা বোধ করত। হিন্দুদের ক্ষেত্রে সে সমস্যা ছিল না। তৃণমূলের জমানায় মুসলিমরা তাদের সম্প্রদায়গত পরিচয় সামনে আনতে কুন্ঠা বোধ করে না। তবে নিশ্চিতভাবে এটাকে প্রাপ্তি বলে না। সংখ্যালঘুরা বহু দেশেই মানসিক সঙ্কটে থাকে। ফলে এমন অনুভূতিও তাদের কাছে প্রাপ্তি বলে মনে হয়। যে শাসকদলের আমলে তারা এমন অনুভূতি উপভোগ করে, তারা সেই শাসকদলকে তুলনামূলকভাবে ‘কাছের’ বলে মনে করে।
বাংলায় তৃণমূল সেই সুবিধাটুকু পেয়েছে। পরে সেটাই শাসক দলকে ভাবাচ্ছে। সংখ্যালঘুর আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে ভোট পাওয়া যায়। সংখ্যাগুরুকে হাতে গরম দিতে হয়। তাতে খরচ আছে। তাদের মন পাওয়া অত সহজ নয়। সে কারণেই কম বেশি সব দলই সংখ্যালঘু নিয়ে রাজনীতির সহজ গেমটি বেছে নেয়। দিদিমনি অবশ্য সংখ্যাগুরুর কথা ভেবে বহু কিছু করেছেন। তাকে আপনি খুব একটা গঠনমূলক নাও বলতে পারেন। কিন্তু তিনি করেছেন। কিন্তু তাতে তাদের মন পাওয়া কঠিন। বিজেপিও সে কথা জানে। তাই তারা সংখ্যাগুরুর মন পাবার চেষ্টা করে অন্য পথে।
তারা বিদ্বেষ দিয়ে বাজি মাত করার চেষ্টা করছে। এতে সুবিধা অনেক। কারও জন্য কিছু করতে হবে না। কেবল সংখ্যালঘুদের প্রতি সংখ্যা গুরুদের মনে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দাও। হিন্দুদের মনে মৌলবাদিতা তৈরী করে দাও। তাহলে তারা হিংসা ও বিদ্বেষে এতটা সময় খরচ করবে যে, লাভ ক্ষতির হিসাব কষার সময় পাবে না। সব বিষয়ে হিন্দু -মুসলিম তুলনা টেনে দাও। টুইটারে তা ট্রেন্ডিং করিয়ে দাও। তাহলেই কাজ হয়ে যাবে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল দলিতদের ওপর যেমন অত্যাচার চলছে চলুক। ওটা তো ‘মনুবাদী ফরমান’। এই দলিতদের একটা অংশকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দাও। যারা এতদিন মর্যাদা পায়নি, তারা এমনিতেই চোটে রয়েছে। এই হিংসা ছড়ানোর কাজটি তাদের হাতে সপেঁ বিজেপি দলিতদের বুঝিয়ে দিয়েছে ‘মনবাদী দলে’ তাদের গুরুত্ব কতখানি।
এই ভয়ংকর খেলায় যারা মত্ত, তারা থাকুক। কিন্তু মিম যেন না আসে। লোকসভা নির্বাচন এলেই, কংগ্রেসের একসময় প্রধান কাজ ছিল, জনগণকে এই বলে ভয় দেখানো যে , ‘আমাদের ভোট না দিলে বিজেপি চলে আসবে ।’ এইভাবে কংগ্রেস বিজেপিকে আটকাতে পারেনি। যে দলকে মানুষ এমন নেতিবাচক প্রচার করে রুখতে চায়, তার পথ সুগম হয়ে যায়।
খামোকা মিমের পথ আটকানোর চেষ্টা না করে তথাকথিত ধর্মনিরেপেক্ষদলগুলির উচিত আত্মনুসন্ধান করা। কেন মিম তাদের ভোট কাটতে সক্ষম হবে তা ভাবা। বিজেপির জূজূ আজ আর কাজ করবে না। গোটা দেশ এই দলটিকে দেখছে। বিদ্বেষ প্রচার ছাড়া দলটির আর কিছু নেই। আসলে ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখবেন এরা টিকে রয়েছে সেই মুসলিমদের জন্যই। মুসলিমরা আছে বলেই বিদ্বেষ। তা না হলে হিন্দুদের একটা বড় অংশ তাদের কাছে জবাব তলব করবে। চাকরি কোথায় জানতে চাইবে। তখন থালা বাজিয়ে অতি বড় বয়ানবাজ নেতাও রেহাই পাবে না। সবার আগে বিজেপির উচিত মুসলিমদের কাছে এই ভোট রাজনীতির কৃতজ্ঞগতা স্বীকার করা।
যে মিমকে বিজেপির দালাল বলা হয়, সেই এআইএমআইএম সুপ্রিমো সংসদে এবং সংসদের বাইরে বিজেপির সবথেকে জোরদার বিরোধিতা করেন। স্বঘোষিত ধর্ম নিরপেক্ষ বলে দাবি করা দলগুলির কোনও প্রতিনিধি তাঁর মত এমন করে কেন্দ্রীয় শাসক দলের ঔদ্ধত্বের প্রতিবাদ করেননি। এমন যুক্তিনিষ্ঠ ভাষণ দিতে পারেন নি। তিনি কেবল মুসলিমদের কথা বলেছেন এমন নয়। একই সঙ্গে সর্বদায় দলিত নিগ্রহ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। যাঁরা তাঁর এই সরব হওয়াকে রাজনীতি বলে মনে করেন, তাঁরা আসলে কি করেন ? সেটা রাজনীতি নয়?
রইলো বাকি সাম্প্রদায়িকতা। এটা ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন নয়। কংগ্রেসের ধর্মনিপেক্ষতার আড়ালে ছিল সাম্প্রদায়িকতা। বাংলার বাম নেতাদের মধ্যেও তা ছিল। দলটির ভিতরে তা প্রবলভাবে ছিল বলেই তারা বিজেপির ভোট ব্যাঙ্ককে এমনভাবে মজবুত করেছে। তৃণমূলের ভিতরেও রয়েছে। বহু নেতা এখন জল মাপছে। এরা মানসিকভাবে ধান্দাবাজ এবং সাম্প্রদায়িক। তাহলে এআইএমআইএম বাংলায় এলে সমস্যা কোথায় ? তাদের কপটতা নেই বলে? বিজেপির সাম্প্রদায়িকতাকে যদি আপনি মেনে নিতে পারেন , তাহলে এআইএমআইএমে আপনার অসুবিধা হবার কথা নয়।
যাঁরা মিমকে ভিলেন হিসাবে দেখাতে চাইছেন তাদের বলি, লোকসভায় বিজেপি যে বাংলায় অভাবনীয় ফল করল তা কি মিমের কারণে? একের পর এক রাজ্য যে কংগ্রেসের কাছ থেকে বিজেপি ছিনিয়ে নিল তা কি মিমের জন্য ? স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি যে অসংখ্যা দাঙ্গা হয়েছে তাঁর নেপথ্যে কি মিম ? গুজরাট দাঙ্গায় কি মিম ছিল ? দিল্লি দাঙ্গা কি মিমের কারণে হয়েছে ? কালো টাকা ফিরিয়ে আনার কথা কি মিম বলেছিল ? প্রতিবছর ২ কোটি কর্ম সংস্থানের প্রতিশ্রুতি কি মিম দিয়েছিল? নীরব মোদী কি মিমের কারণে চম্পট দিয়েছে ? দেশের আর্থিক সর্বনাশ কি মিম করেছে ? বাংলায় সিপিএম চলে যাবার পরও যে সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব সেইভাবে বাড়েনি তার জন্য দায়ী কি মিম? তাহলে যারা মিমের বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে তারা আসলে কাদের দালাল সেটা তাদের ভেবে দেখবার সময় হয়েছে বৈকি।
একথা ঠিক যে ধর্ম কেন্দ্রিক রাজনীতি অত্যন্ত খারাপ। তবে ধর্মনিরপেক্ষতার ভান করে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি আরও খারাপ। মুসলিমরা রাজনীতির ক্ষেত্রে ধর্মকে গুরুত্ব দেয় না। সে কারণে গোটা দেশে মুসলিমদের রাজনৈতিক দল নেই। তারা সেটা চায়ও না। আসাদউদ্দিন ইসলামী দলও বানাননি। এটি বাকি রাজনৈতিক দলগুলির মতই। এর সঙ্গে মূল ইসলামের অর্থাৎ শরীয়তের সম্পর্ক নেই। আপনি যদি মনে করেন যোগী আদিত্যনাথ যা বলেন, তা উপনিষদ ও গীতা পড়ে, তাহলে তা আপনার ভুল। উনি যা বলেন তা হিন্দুত্ব নয়। তা ওঁর ভাষণ। কখনও কখনও বিদ্বেষ ভাষণ। গীতায় তার জায়গা নেই। তাই ওয়াইসির মাথায় টুপি এবং শেরওয়ানি দেখে ভুল বুঝবেন না। এর সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক নেই। এটি আর পাঁচটা দলের মতোই। কেবল এর সমালোচনা করা মত যথেষ্টডেটা এখনও আমাদের হাতে নেই।
আরও পড়ুন : সংসার সীমান্ত ছেড়ে তিন ভুবনের পারে, ফিরে দেখা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত অনবদ্য চলচ্চিত্রগুলি