‘রাধা কলঙ্কিনী’ ও ‘কানু হারামজাদা’ না লিখেও মৌলবাদী গেরোয় বাউল সম্রাট

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on telegram
Share on whatsapp
Share on email
Share on reddit
Share on pinterest

অভিজিৎ সিনহা

সর্বত্রই কিছু লোক থাকেন যাঁরা কারণে-অকারণে বিতর্ক সৃষ্টি করতে ভালোবাসেন। ইদানিং সেইসব লোকদের প্রাদুর্ভাব ঘটছে বাংলায়। এঁদের একমাত্র লক্ষ্য, অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলার প্রধান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ বাধিয়ে দেওয়া।

সম্প্রতি একটি গান নিয়ে এই একই অসদুদ্দেশ্যে বিতর্কের সৃষ্টি করা হচ্ছে। গানটি নেটফ্লিক্সে মুক্তি পাওয়া একটি সিনেমার। অনুষ্কা শর্মার ‘ক্লিন সেট ইমেজ’ প্রযোজিত ওই সিনেমার একটি গানে ‘কানু হারামজাদা’ কথাটি রয়েছে। বিরোধ সৃষ্টিকারীদের বক্তব্য, গানটি বাংলাদেশের গীতিকার শাহ আব্দুল করিমের রচনা। হিন্দুধর্মকে অপমান করার উদ্দেশ্যেই নাকি আব্দুল করিম এমন পদ রচনা করেছেন। আমরা এই অভিযোগের সত্যতা কতটা তা যাচাই করে দেখব।

শাহ আবদুল করিমের জন্ম ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের সিলেট জেলার সুনামগঞ্জে। ছোটবেলা থেকেই তিনি বহু পদ রচনা করলেও তা শুধু সিলেট জেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ঘটে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তিনি শেখ মুজিবরের পাশে ছিলেন। ওই সময় মুজিবকে উদ্দেশ্য করে তাঁর লেখা ‘দরদি, বাংলার নাও সাজাইয়া লও’ ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। তিনি ২০০১ সালে ‘বাউল সম্রাট’ উপাধি পান। ছোট থেকেই তাঁর প্রেরণা ছিল লালন শাহ, দুদ্দু শাহ, পানজু শাহর মতো বাউল পদকর্তারা। তাঁদের অনেক গান তিনি গাইতেন। তা হলেও তিনি প্রথাগত বাউল ছিলেন না। তিনি গণসংগীত, শরিয়তি ও মারিফতি গানও লিখতেন এবং গাইতেন। তবে তিনি বৈষ্ণব গান লিখেছেন বলে শোনা যায় না।

ঠিক এই জায়গা থেকেই মনে হয়, যে গানটি নিয়ে এত বিতর্ক, সেটি শাহ আব্দুল করিমের রচনা নয়। গানটি শুনলে বোঝা যাবে, সেটি আদ্যোপান্ত বৈষ্ণব সংগীত। ‘কানু হারামজাদা’ কদমডালে বসে আছে বলে রাধাকে জলে যেতে বারণ করা হচ্ছে এখানে। অনুরূপ একটি গান বহুদিন ধরেই প্রচলিত বাংলায়। ‘কাদের কূলের বউ গো তুমি, কাদের কূলের বউ/ যমুনায় জল আনতে যাচ্ছ, সঙ্গে নাইকো কেউ’। আর বাংলায় আদর করেই হারামজাদা, লম্পট, চোর ইত্যাদি বলা হয়ে থাকে। কৃষ্ণের অপর নামই তো ননীচোরা।

আরও পড়ুন: আর্থিক সংকট মোকাবিলায় জাতীয়তাবাদ ভ্যাকসিন ব্যবহার করছে বিশ্ব নেতৃত্ব

এ-সব অবশ্য হিন্দুত্ববাদীরা বুঝবে না। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা সৃষ্টি করাই তাদের আসল অভীষ্ট। তার জন্য তো বাংলাকে জানার প্রয়োজন নেই। জানার দরকার নেই যে বাংলার কৃষ্ণ আর মহাভারতের কৃষ্ণ সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু আমরা তথ্যের দিকে যাব। তাতে দেখব, গ্রন্থিত, অগ্রন্থিত শাহ আব্দুল করিমের কোনো বইয়েই এই গানটির উল্লেখ পাওয়া যায় না। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শাহ আব্দুল করিমের অন্যতম প্রধান শিষ্য শাহ আব্দুল রহমান জানিয়েছেন, ‘তাঁর (শাহ আব্দুল করিম) অধিকাংশ গানের পান্ডুলিপি আমার হাতে লেখা। তাঁকে কখনই এমন গান পরিবেশন করতে দেখিনি। তাঁর শিষ্যরাও এমন গান পরিবেশন করিনি।’

RadhaKrishna

তা হলে এই গানটি লিখলেন কে। এই বিষয়ে যাওয়ার আগে জানানো যাক, বাংলাদেশেও শাহ আব্দুল করিম নিগৃহীত। নামাজি মুসলমানদের সঙ্গে বাউলদের বিরোধ এই বাংলার মতো ওই বাংলাতেও আছে। বরং আরো বেশি করে আছে। যার শিকার বারেবারেই হতে হয়েছে শাহ আব্দুল করিমকে। স্ত্রী আফতাবুন্নেসা তথা সরলার দেহান্তের পর লাশ জানাজা করার লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্থানীয় মসজিদের ঈমামকে এ-বিষয়ে অভিযোগ করতে গেলে তিনি বলেন, ‘বাউলের বউয়ের আবার জানাজা কী?’ বোঝা যায় সবটাই ঘটেছে ঈমামের অভিপ্রায়ে। মুসলিম মৌলবাদীদের হাতে নিগৃহীত সংগীত সাধক এ-দেশে হিন্দু মৌলবাদীদের হাত থেকে রেহাই পেলেন না। এটাই আশ্চর্যের।

অনেকে এই গানটিকে বলছেন রাধারমণ দত্তের লেখা। হতেও পারে। ১৮৩৩ সালে ওই সিলেটেই জন্ম নেন রাধারমণ। তিনি ছিলেন বাউল বৈষ্ণব। অর্থাৎ সহজিয়া বৈষ্ণব। রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক অনেক গান রচনা করেছেন তিনি। তাঁর মোট গানের সংখ্যা তিন হাজারের বেশি বলে মনে করা হয়। এখনো পর্যন্ত তাঁর সব গান উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে গ্রন্থিত রাধারমণী গানের মধ্যে এই গানটি নেই। বাংলাদেশের বিশিষ্ট লোকসংগীত গবেষক সুমন কুমার দাশ তাই এই গানটিকে রাধারমণ রচিত বলে মনে করেন না। তবে এটা যে শাহ আব্দুল করিমের রচনা নয়, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। একটি হীন উদ্দেশ্যেই এই মিথ্যাপ্রচার করা হচ্ছে।

এই মিথ্যাপ্রচার আমরা আগেও দেখেছি। ভোজপুরী ছবির ভিডিয়ো দেখিয়ে তাকে বসিরহাটের বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছে। পাকিস্তানের একটি মহল্লার ছবি দেখিয়ে তাকে রাজাবাজারে লকডাউন মানা হচ্ছে না বলে দেখানো হয়েছে।সবকিছুই করা হচ্ছে ঘৃণা ছড়াবার উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু এরা জানে না যে মিথ্যার ফানুস বেশিক্ষণ ওড়ে না।

আরও পড়ুন: পোষমানা স্বাধীনতা…

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on telegram
Share on whatsapp
Share on email
Share on reddit
Share on pinterest