লকডাউনের জেরে নেই জন সমাগম, ইতিহাসের নীরব ফিসফিসানি হুগলি ইমামবাড়া জুড়ে…

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on telegram
Share on whatsapp
Share on email
Share on reddit
Share on pinterest

সাল ১৭৭০। বাংলার ভাগ্যাকাশে নেমে এল নতুন এক বিপর্যয়। সুজলা-সুফলা জমি ক্রমে হয়ে উঠল বন্ধ্যা। অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকারের ভাঁড়ার পূরণ করতে গিয়ে বাংলার কৃষকের হাঁড়ি শূন্য। অনাবৃষ্টিতে তার আগের বছরই ফলনে ঘাটতি দেখা গিয়েছিল। কিন্তু কোম্পানী রাজের রাজস্ব আদায়ে ভাঁটা পড়ার জো ছিল না। ফলস্বরূপ দেখা দিল দুর্ভিক্ষ, মহামারী। বাঙালির ইতিহাসে যা ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ বলে পরিচিত।  সেটা ছিল ১১৭৬ বঙ্গাব্দ।

ভয়ংকর দুর্ভিক্ষে সেবার বলি হন এক কোটি মানুষ। সংখ্যাটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বন্দি হওয়া মোট ইহুদিদের সংখ্যার তুলনায় অনায়াসে কয়েক লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে। মুছে যায় বাংলার মোট জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ । অনাহার কবলিত জনতার সহায়তায় এগিয়ে আসেন দরদী হিতৈষী ব্যবসায়ী হাজী মুহাম্মদ মহসিন। সরকারি দলিল বলে, তৎকালীন দুর্ভিক্ষের সময় তিনি প্রচুর লঙ্গরখানা স্থাপন করেন এবং সরকারি তহবিলে অর্থ সহায়তা প্রদান করেন। জীবিত অবস্থায় বাংলার এই দানবীর তাঁর সম্পত্তি মুক্ত হস্তে বিলিয়ে দিয়েছেন দুঃস্থ-অসাহয়ের স্বার্থে।

তাঁর মহানুভবতার সঙ্গে বোধহয় তুলনা চলে একমাত্র হাজী মহসিনের স্মৃতিতে নির্মিত ইমামবারার। যেখানে এই মহাত্মার কবর শায়িত রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে, হুগলি জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান, পর্যটনের কেন্দ্রবিন্দু এই ইমামবারা। শিয়া সম্প্রদায়ের মিলনক্ষেত্র, বিপুলাকৃতির সৌধটি ১৯ শতকের বাংলার ভাস্কর্যের নিদর্শন বটে। ধর্মীয় স্থান হিসেবে চিহ্নিত হলেও, ইমামবারার অঙ্গনে সারা বছর সব ধর্মাবলম্বীদের অবাধ প্রবেশ। ১৮৬১ সালে ইমামবারা নির্মাণ শেষ হয়। এটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল প্রায় কুড়ি বছর এবং সে সময়ে খরচ হয়েছিল পৌনে তিন লক্ষ টাকা।

তৎকালীন পারস্য বা আজকের ইরানের ধনী লবণ ব্যবসায়ী হাজী ফায়জুল্লহর নাতি ছিলেন হাজী মহসিন। মুর্শিদাবাদেও ব্যবসা ছিল তাঁর। ফায়জুল্লহ শেষ বয়েসে হুগলিতে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। মুর্শিদাবাদে পড়াশুনা শেষ করে পশ্চিম এশিয়া ও তুরস্কের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞানলাভ করে হুগলিতে থিতু হন হাজী মহসিন। শুধু ইতিহাসবিদ বা সেকালের একজন গণিত বিষয়ক পণ্ডিতই নন, হাজী মহসিন ছিলেন একজন অতি দক্ষ কারিগর। দুর্ভিক্ষের সময় আর্তদের পাশে দাঁড়িয়ে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে ‘সন্ত’ রূপে চিহ্নিত হয়েছিলেন মহসিন। তাঁর সৎ বোন ছিলেন মাননুজান খানম। হাজী মহসিনের মায়ের প্রথম পক্ষের সন্তান ছিলেন মাননুজান। পিতার বিপুল সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। তার উপর হুগলির ডেপুটি গভর্নর সালাউদ্দিনের বিধবা তিনি। সন্তানাদি না থাকার কারণে ১৮০৩ সালে সৎ ভাই মহসিনকে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে মারা যান মাননুজান। হাজী মহসিনের বয়েস তখন ৭১। তার উপর তিনি চিরকুমার।

১৮০৬ সালে সমস্ত সম্পত্তি কাগজে কলমে দান করে যান হাজী মহসিন। বিশাল সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণে একটি ট্রাস্ট গঠন করা হয়। জমি-জায়দাদের উপর আরোপিত সরকারি কর বাদ দিয়ে আয়ের ন’টি সমান ভাগ করা হয়। ঠিক হয়, তিন ভাগ আয় ব্যয় করা হবে মহরম উৎসব এবং লোকলয়ের সমস্ত ইমামবার-কবরস্থান রক্ষণে। ট্রাস্ট চালানো ও কর্মচারীদের মাইনের পিছনে চার ভাগ খরচ হবে। ট্রাস্ট চালানোর মূল দায়িত্ব থাকবে দু’জন ম্যানেজার বা মুত্তাওয়াল্লীর হতে। তাঁদের জন্য ব্যয় হবে শেষ দু’ভাগ।

 

WhatsApp Image 2020 08

                                                             ভেঙে চুড়ে যায় আমাদের ঘরবাড়ি…(ছবি: বিপ্লব বিশ্বাস)

১৮১২ সালে হাজী মহসিন দেহত্যাগ করেন। তবে তাঁর গঠিত ট্রাস্ট বাংলায় বিদ্যালয়-কলেজ ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করে গিয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম ১৮৩৬ সালে তৈরি হুগলি জেলার মহসিন কলেজ। যেখানে পড়াশোনা করেছেন লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো ছাত্র। বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশে একাধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যা ‘মহসিন ফান্ড’-এর তৈরি।

আরও পড়ুন: হিমালয়ের হাতছানি! পর্যটকদের জন্য খুলতে চলেছে হিমাচলপ্রদেশ, মানতে হবে স্বাস্থ্য বিধি

হাজী মহসিন ট্রাস্ট-এর নিযুক্ত মুত্তাওয়ালি সৈয়দ কেরামত আলী ১৮৪৫ সালে ইমামবারা নির্মাণের দায়িত্ব নেন। বলা হয়, ১৭ শতাব্দীর এক পুরোনো এক মহলা ভবনের প্রাঙ্গনে ইমামবার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এখন অবশ্য চৌকাঠ পেরোলেই চতুর্ভুজাকৃতী দালান। তার চারদিকেই দোতলা ভবন। পূর্বদিকে প্রধান উপাসনালয় বা জারিদালান। তার মেঝে চক-মেলানো। জারিদালানের অন্দরে নবী মুহম্মদ(সাঃ), বিবি সায়েদা ফাতিমা, হজরত আলী (আঃ সঃ), ইমাম হুসেনের (আঃ সঃ) স্মৃতিতে পাঁচটি তাজিয়া রাখা আছে। জারিদালানে কিন্তু ছবি তোলা বারণ।

                                বলো কোথায় তোমার দেশ…তোমার নেই কি চলার শেষ…(ছবি: বিপ্লব বিশ্বাস)

হুগলি নদীর তীরবর্তী ইমামবরার বাহির দেওয়ালে হাজী মহম্মদ মহসিনের আসল তোলেয়াতনামার প্রতিলিপি রয়েছে। ফার্সি এবং ইংরেজিতে।  প্রার্থনা স্থল এর ডানদিকে হুগলী নদী। যদি মন বলে কিছু থাকে তবে তা অনুভব করার জন্য, এ এক বিপুল আয়োজন।

ইমামবারা  আক্ষরিক অর্থে ইমামের বাসভবন। ইমামবারাকে অনেকে ইমামবাড়ী ও বলে থাকেন। মূলত শিয়াপন্থী মুসলিমরা মহরম উৎসব পালনের জন্য এটি নির্মাণ করেছিল। গোটা বাড়িটা দোতলা। এখানে একটি ত্রিভুজাকৃতি অঙ্গন রয়েছে। তবে ইমামবাড়ার সবথেকে আকর্ষণীয় স্থান হল ৮৫ মিটার উঁচু দুটি স্তম্ভ। এর একটি পুরুষ ও একটি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। দুটি স্তম্ভে ১৫২টি করে ঘোরানো সিঁড়ি আছে, এবং সবচেয়ে উপরে একটি ঘড়ি আছে। ঘড়ির যন্ত্রপাতিও ঘন্টা আছে নিচের তলায়।

লন্ডন শহরে গিয়ে বিগ বেন দেখার সৌভাগ্য ক’জনের আর হয়! যাঁদের হয় না, তাঁরা আসতে পারেন এই ইমামবাড়ায়। ব্রিটিশ স্থাপত্যের বদলে পাবেন ইসলামি শিল্পকলার স্বাদ, আর ওই মিনারের সংকীর্ণ সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় যখন ঘণ্টাটা বেজে উঠবে, তখন যেন মনে হবে সেই ঘড়িতে নয়, ঘণ্টাটা বাজছে একেবারে হৃদয়ের মধ্যে।

bellnew 052918082605

ইমামবারার অঙ্গনে একটি সূর্য ঘড়ি আছে। এছাড়া এখানে অনেকগুলি ঝর্ণা এবং কৃত্রিম জলাশয় রয়েছে। তবে বর্তমানে ঝর্ণাগুলি থেকে জল পড়ে না এবং জলাশয় এর জল ও সবুজ হয়ে গেছে। স্তম্ভ দুটির মাঝখানে যে বিশাল ঘড়ি রয়েছে তার প্রস্তুতকারক সংস্থা কিন্তু লন্ডনের ব্ল্যাক এণ্ড হুড়রাহ কোম্পানী। বিগত দিনে তার দাম ছিল প্রায় সাড়ে ১১ হাজার টাকা।

dialbody 052918083310

বিরল এই স্থাপত্যে নিয়ে তেমন চর্চা হয়না। খানিকটা অনাদর চোখে পড়বে সেখানে গেলেই। তবে যারা ইতিহাসপ্রেমী তারা এখানে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়বেন। মনে হবে ইতিহাস যেন ফিসফিসিয়ে কথা বলছে এখানে। একবার গেলে বারবার এই ইতিহাসের চাপা কণ্ঠস্বর শুনতে ইচ্ছা করবে। যে কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে হারিয়ে যায় জনসমাগমে। তবে এখন অসীম নীরবতা…সেই নীরবতায় যেন নিজের সঙ্গেই আলাপচারিতায় মগ্ন এই প্রাচীন ইমামবাড়া।

আরও পড়ুন: সোনার হোটেল! ছোট করে ট্যুর করে নিন, এক ক্লিকে তবে ভাড়া শুনলে চমকে উঠবেন…

 

 

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
Share on telegram
Share on whatsapp
Share on email
Share on reddit
Share on pinterest