সৈয়দ আলি মাসুদ
রাজনীতি শব্দের অর্থ যাই হয়ে থাক না কেন, সেখানে যে নীতির কোনও ঠাঁই নেই তা বিশ্বজনীন। রাজনীতিজীবীদের চরিত্রে যা স্পষ্ট হয় তা হল–প্রবঞ্চনা, শঠতা, দুর্নীতি, নির্লজ্জতা ,হিংসা ও ধর্মীয় বিদ্বেষ। মুসলমানের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ ও ঘৃণা বিজেপির রাজনীতিজীবীদের ইউএসপি। তবে বাকি দলগুলি অবশ্যই ধোয়া তুলসীপাতা নয়। সেখানেও বিদ্বেষ থাকে । থাকে ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সংস্কৃতির পোশাকে। সকলেই তা জানে। এটা একটা ‘হিডেন সিক্রেট।’ পুলিশ ঘুষ খায় টাইপের ব্যাপার। হয়ত কোনও কোনও পুলিশ ঘুষ খান না। তাঁরা সৎ। কিন্তু সংখ্যায় তাঁরা এতই কম যে তাদের কথা মাথায় রেখে কোনও ধারণা তৈরী করা সত্যিই কঠিন।
আরও পড়ুন : বিজেপি ছেড়ে আজই তৃণমূল কংগ্রেসে ফিরতে পারেন পুত্র সহ মুকুল রায়
এদেশের রাজনৈতিক দলগুলোও তেমনি। বিদ্বেষ নেই এমন দল পাওয়া সত্যিই কঠিন। তবে সবাই বিদ্বেষকে গোপন করার চেষ্টা করে। একমাত্র বিজেপি তাকে উজ্জাপন করে। এখানে বাম-ডান সব দলের ভিতরেই থাকে বিদ্বেষ। সব দলই নীতিহীন। দক্ষিণপন্থী দলগুলির নীতি নিয়ে সূচিবায়ুতা নেই। নীতি, আদর্শ নিয়ে গলা ফাটায় বাম দলগুলি। বাংলায় বামদল বলতে সকলে জানে সিপিএম। বাকি দলগুলো এখানে চিরকালই ‘দুদুভাতু’। সিপিএমের লেজুড়। বাংলায় ৩৪ বছর শাসন করেও ক্ষমতায় তৃষ্ণা এদের মেটেনি। ক্ষমতায় থাকাটাকে এরা উত্তরাধিকার মনে করেছিল। ক্ষমতায় এদের নেশা ধরে গিয়েছিল।ক্ষমতায় থাকার নেশা কামের থেকেও মারাত্মক। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে সিপিএম তা আগেই প্রমাণ করেছে।
নিবন্ধের প্রেক্ষাপট বাংলা ও বাংলার রাজনীতি। সিপিএমের শাসন ও তাদের পরাজয়। শেষ পর্যন্ত বিলীন হয়ে যাওয়া। যেকোনও রাজনৈতিক দলকে চেনার সবথেকে ভালো জায়গা হল গ্রাম। সেখানেই তার মুখোশ খুলে যায়, বের হয়ে আসে দানব রূপ। নীতির গণসংগীত গাওয়া বাম কুল প্রশ্ন তুলতেই পারেন,বাংলায় কি তারা কিছু করেনি। কোনও উন্নয়ন কি তাদের হাত ধরে হয়নি? যারা ৩৪ বছর সরকারে ছিল তারা কিছু কাজ করেছে নিশ্চিত। সেটা করতেই হয়। তবে কাজ করে তারা ক্ষমতায় টিকে ছিল না। তারা ক্ষমতায়টাই ছিল অন্য ছকে।
কংগ্রেসের অত্যাচার, অবিচার, মস্তানি দেখে বাংলার মানুষ বিকল্প খুঁজছিল। সিপিএম সেই সময় হয়ে উঠেছিল বিকল্প। মানুষ তাদের বিশ্বাস করেছিল। তাদের নেতারা প্রাথমিক পর্বে অনেকেই কমিউনিস্ট হবার অনুশীলন করেছিলেন। কিন্তু যারা এই অনুশীলনের চেষ্টা করেছিলেন তারা নেহাতই ছিলেন হাতে গোনা। তাদের অনেকে আবার মার্কস সাহেবের দর্শনকে সেইভাবে বুঝেছিলেন, যেভাবে একজন ধর্মান্ধ হিংসাকে ধর্ম বলে মনে করে। বাংলায় তারা একটা অনূদিত সমাজ ও রাষ্ট্র দেখতে চেয়েছিলেন। রাশিয়া ও চীনের পাইরেটেড কনসেপ্ট এখানে খাপে খাপ বসানোর চেষ্টা হয়েছিল।
সেই চেষ্টা করতে গিয়ে তারা গ্রামে একটা চরম বিদ্বেষের পরিবেশ তৈরী করেছিল। তাদের তখন বুর্জোয়া ও প্রলেতারিয়েত দরকার। দুটি শ্রেণীর মধ্যে সংঘাত দরকার। তবে তো জমবে পালা। এটা করতে গিয়ে তারা প্রতি গ্রামে জন্ম দিলেন একদল অসৎ, অসভ্য শ্রেণী। রাজনৈতিকভাবে ছক করে কোনও না কোনও গ্রামের ভদ্রলোকদের অপমান ও অপদস্ত করা ছিল সিপিএমের ‘বিপ্লব’। ক্ষমতায় ঠিক থাকার সস্তা উপায়। যারা সেদিন ভদ্রভাবে গ্রামে বাঁচতে চেয়েছিল, তাদের ‘ভিলেন’ বানিয়েছিল কমরেডরা।
আত্মসম্মান বিক্রি না করা এই ভদ্রলোক বাঙালি মুসলিম পরিবারগুলির ওপর শুরু হয় অত্যাচার। সে অত্যাচার ছিল ভয়াবহ। কথায় কথায় তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করা হত। এই পরিবারগুলি কিছু জমি-জিরেতের মালিক ছিলেন। সেটাও এমন কিছু বেশি ছিল না। তখন ফসলের উৎপাদনও বেশি ছিল না। তাছাড়া এই পরিবাগুলোতে কত মানুষ যে দুবেলা খেত তার হিসাব ছিল না।কেউ হিসেবে রাখতও না। এরা কেউ বাবুয়ানি করেনি। দুবেলা মোটা ভাত কাপড় তাদের জুটে যেত। যে খাবার তারা খেতেন সেই একই খাবার খেত তাদের বাড়ির কাজ-কামের লোকজন। তাদের পোশাকও থাকত নেহাতই সাধারণ। যারা তাদের বাড়িতে কাজ করত, তাদের গোটা পরিবার পালিত হত এই পরিবারগুলোর ঘরেই। এদেরই সিপিএম বুর্জোয়া বলে অপপ্রচার শুরু করে। কংগ্রেস জমানায় সম্মানিত মুসলিম পরিবারগুলোকে ‘টাইট’ দেওয়া শুরু হয়েছিল, সিপিএম এসে তাকে পাকা করে ফেলে।
সম্ভ্রান্ত বাঙালি মুসলমানদের একটা বড় অংশ পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। তাদের বর্তমান প্রজন্ম আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে ভালোই রয়েছেন। অন্তত আর্থিক দিক দিয়ে। আর এখানে যারা ভিটের টানে, মাটির টানে থেকে গেলেন, তারা বুঝলেন মাটিকে ভালোবাসার সাজা কাকে বলে। সেই সাজা যদি তাদের বিজেপির মত কোনও দল দিত, তাহলে ততটা দুঃখ ছিল না , কিন্তু এই সাজা দিয়েছে ধর্ম নিরপেক্ষতার বুলি কপচানো সিপিএম। সিপিএম ততদিনে অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত মুসলিমদের মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়ে ঘোর ধরিয়ে দিয়েছিল। শিক্ষিত মুসলিম পরিবারগুলির প্রতি অশিক্ষিত মুসলিম পরিবারগুলির মধ্যে তীব্র বিদ্বেষ ছড়িয়ে দিয়েছিল। সব যুগেই ভদ্রলোকের সংখ্যা কম। ফলে এই মুসলিম পরিবারগুলোকে শেষ করতে সিপিএমের বেশি দিন লাগেনি।
এদের জমি কেড়ে নিয়ে সিপিএম গরিব দরদী হয়েছিল । এদের পুকুরের মাছ লুট হয়েছে। জমির ধান প্রকাশ্যে কেটে নিয়ে গিয়েছে লাল পার্টির লোকেরা। সামান্য বাধা পর্যন্ত দিতে পারেননি তারা। গ্রামের পার্টির নেতাদের স্বপ্ন ছিল শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত মুসলিম বাড়ির মেয়েদের পুকুর ঘাটে নামিয়ে আনা। তবে সেদিনও অশিক্ষিত মুসলিমরা বোঝেননি সিপিএমের ছক। আসলে সিপিএম সেদিন থেকেই গ্রামের শিক্ষিত ও রুচিশীল মুসলিম পরিবারগুলিকে ধনে প্রাণে শেষ করতে চেয়েছিল। তা না হলে তারা অশিক্ষিতদের মাথায় ছড়ি ঘোরাতে পারবে না। এই অশিক্ষিত মুসলমানদের হাতে অসভ্যতা করার খোলা ছুট দেওয়া হল। স্বাভাবিকভাবেই তারা যে পরিবারগুলোতে প্রতিপালিত সেখানে শুরু করল অত্যাচার। শহুরে বিপ্লবী কমরেডরা এই রুচিশীল মুসলিম পরিবারগুলির মর্মন্তিক অবস্থা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করেছে।
তবে কেবল যে রুচিশীল মুসলিম পরিবারগুলিকে সিপিএম নিশানা করেছিল এমন নয়। রুচিশীল ঘটি হিন্দুরাও ছিল সিপিএমের নিশানায়। তবে মুসলিম পরিবাগুলিকে বেশি অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। কারণ সিপিএম অশিক্ষিত মুসলিমদের পাকাপাকিভাবে পাশে পেয়ে গিয়েছিল। তাদের দিয়েই ভদ্রলোক মুসলমান পরিবারগুলোর ওপর রাজনৈতিক অত্যাচার অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। এই পরিবারগুলির খুঁটির জোর ছিল না। সম্ভ্ৰান্ত হিন্দুদের অবস্থা তেমন ছিল না। রাজনৈতিক দলে এদের মামা, কাকা ছিল। একথা ঠিক যে, সিপিএমের নানা বদগুণ থাকলেও তখনও মনে হত না যে, আরএসএস তাদের বাসায় ডিম পেড়ে গিয়েছে।
তৃণমূল না এলে এটা এমনভাবে প্রকটও হত না। কংগ্রেসের ভিতরে যে আরএসএস মতাদর্শের লোক রয়েছে, তা স্পষ্ট হয়েছে সেই দেশভাগের আগে থেকেই। কিন্তু সিপিএম মুখোশটা পড়েছিল টাইট ভাবে। খসে পড়ার কোনও চান্স ছিল না। সিপিএমে ভোট দেওয়া এবং আনুগত্য প্রদর্শনকারী মুসলিমরা প্রথম চমকে ওঠেন কবি সুকান্তের ভাইপো, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টচার্যের কথা শুনে। বাংলার মাদ্রাসায় জঙ্গি তৈরী হয় বলে তিনি অবলীলায় মন্তব্য করেছিলেন। সুর কেটেছিল সিপিএম ভক্ত মুসলিমদের মনে। ততদিনে বহু কমরেড মসজিদমুখী হয়েছিলেন। তারা পড়লেন চাপে। বুদ্ধ বাবু ক্ষমা চাইলেন। বুদ্ধবাবু দুঁদে রাজনীতিবিদ ছিলেন না। ছল, কপট তিনি তেমন একটা পারতেন না। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তা বলে ফেলেছিলেন। বুদ্ধবাবুর মতই বাংলার শহুরে কমরেডরা অনেকে আজও বিশ্বাস করে মাদ্রাসায় জঙ্গি তৈরী হয়। মুসলিমদের সম্পর্কে তারা অনেকেই আজও নিচ ধারণা পোষন করেন। সেখানেই আরএসএসের সাফল্য।
ক্ষমতায় ফেরার নির্লজ্জ উপায় হিসাবে সিপিএম আগেই কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল। এই কংগ্রেসের অত্যাচারের কিছু সত্য এবং অসংখ্য মিথ্যা কাহিনী শুনিয়ে কমরেডরা এক সময় ভোট জিতেছে। সেই কংগ্রেস এখন তাদের দোসর। বিজেপি চরম বিদ্বেষী জেনেও তারা মমতাকে আটকাতে বিজেপির পথ মসৃন করা চেষ্টা করল। তারা চেয়েছিল তৃণমূলকে হঠিয়ে বিজেপিকে আনতে। অথচ এই দলটির একমাত্র কাজ যে বিদ্বেষ ছড়ানো তা যে সুজন বাবুরা জানেন না তা নয়। তবু তারা গুজরাটি আগ্রাসন মেনে নিয়েছিলেন। ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পরও মুসলিম ভোটের ব্যাপারে তাদের আত্মবিশ্বাস ছিল না। ভ্যাটিকান যেমন পোপের রাজত্ব, তেমনই বাংলায় কংগ্রেসের রাজত্ব ছিল মালদা ও মুর্শিদাবাদ। সেখানকার ‘আহাম্মক’ মুসলিমদের ভোট ছিল কংগ্রেসের একমাত্র মূলধন। অধীর এবারও সেদিকেই তাকিয়ে ছিলেন। ভাইজানকে সঙ্গে নিয়ে সিপিএম মসুলিম ভোটে সিঁধ কাটতে গিয়েছিল।
কিন্তু তাদের ছেড়ে যাওয়া ৩৪ বছরের শাসনের পর ১০ বছর কেটে গিয়েছে। ফলে মুসলিমদের মধ্যে একটা নতুন প্রজন্ম তৈরী হয়েছে। যে লেঠেল তারা বানিয়েছিল, এখন তারা আর সেখানে দাঁড়িয়ে নেই। তাদের স্পষ্ট রাজনৈতিক ধারণা তৈরী হয়ে গিয়েছে। মাটির সঙ্গে সম্পর্ক না থাকার কারণে সিপিএম তা বুঝে উঠতে পারেনি। সে কারণে ভাইজানের ওপর তারা ভরসা করতে শুরু করেছিল। কিন্তু মুসলমানরা বুঝেছিল, এই ভোট বিজেপিকে ঠেকানোর ভোট। আর বিজেপিকে ঠেকানোর ব্যাপারে একমাত্র মমতা মুসলিমদের আস্থা অর্জনে সমর্থ হন।
সিপিএম নেতারা তাকিয়ে ছিলেন ভাইজানের দিকে। কিন্তু টুপি দাড়িওয়ালা ভাইজানকে তাদের ভোটাররা যে ভালোভাবে নিচ্ছেনা, তা বাম নেতারা বোঝেননি। সিপিমের মধ্যেও বর্ণবাদ প্রবল। আগেই তাদের ভোটাররা বিজেপিতে যেতে শুরু করেছিল। বামের ভোটে বামে না পড়ে রামে পড়তে শুরু করেছিল। ভাইজানকে সঙ্গে নেবার পর তাদের হিন্দুভোটাররা বেশিরভাগই বিজেপিতে চলে যায়। আর মুসলিম ভোটাররা আত্মরক্ষার্থে এবং গুজরাটি আগ্রাসন থেকে বাংলাকে বাঁচাতে তৃণমূলে ভোট দেয়। যে ব্যাপারটি লোকে বলছে না তা হল, সিপিএমেও যে আরএসএস ডিম পেড়ে গিয়েছে তা মুসলিমরা স্পট বুঝে গেল এতদিনে। মালদা, মুর্শিদাবাদও বুঝিয়ে দিল তারা ধরে ফেলেছে। বাংলায় মিশনগুলির দৌলতে আজ বহু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। তাই আজ আর বোকা বানানো সহজ নয়। এবার ভোটে সেটাই হয়েছে। তাই শূন্য হয়ে গিয়েছে সিপিএম কংগ্রেস। কংগ্রেসের পাপে এসেছিল সিপিএম। সিপিএমের পাপে এসেছে তৃণমূল। মমতার দলেও আরএসএসের ডিম যে আছে ইতিমধ্যেই তার প্রমাণ মিলেছে। তাই বাঙালি মুসলিমের কাছে আসলে কোনও দল সম্পর্কে বিগলিত হওয়ার কোনও জায়গা নেই। তাদের কেবল সচেতন থেকে ভোট দিতে হবে। মাথায় রাখতে হবে কারা তাদের জন্য ও বাংলার জন্য কম ক্ষতিকারক। সেই দলকে ভোট দিতে হবে সব রক্ষণশীলতা ছেড়ে।
অভিমত ব্যক্তিগত