Site icon The News Nest

বাংলা সাহিত্যের যে উপন্যাসগুলো জীবনে একবার হলেও পড়া উচিত…

novel

বাংলা ভাষায় লেখা সাহিত্যের সংখ্যা অগণিত। বাংলা সাহিত্যের মত বৈচিত্রপূর্ণ ও সুবিদিত সাহিত্য খুব একটা বিশেষ নেই। কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, যাত্রাপালা, কবিগান, আরও কত বিচিত্র পসরাই না সাজিয়েই রেখেছে এই বাংলা সাহিত্য! সবদিক দিয়েই অনন্য সমস্ত রচনা আছে বাংলা সাহিত্যে। আমাদের সাহিত্যের যে বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে আমাদের সামনে অনেকেই আমরা তা জানি না কিংবা আগ্রহ করে দেখি না। আজ বলবো এমনই পাঁচটি উপন্যাসের কথা, যে উপন্যাসগুলো এক একটি নক্ষত্র, যারা যুগ যুগ ধরে জ্বলতে থাকবে বাংলা সাহিত্যের আকাশে।

শেষের কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

‘শেষের কবিতা’ বাংলার নবশিক্ষিত অভিজাত সমাজের জীবনকথা। ব্যক্তি মানুষের মূল্যচেতনার উপাদান যদি অন্তর থেকে শুধুই বার হয়ে আসতে থাকে; যার সমুন্নতি ও দীপ্তি বিদ্যার বৃহৎ পরিমার্জনায়, তারও একটা চরিত্র আছে। বাস্তব চেনাশোনার চলা বাহ্যিক অভিজ্ঞতার জগৎ থেকে তা একেবারে অন্তর অভিমুখী। এই নবতর চেতনার অদ্ভুত আবিষ্কার এই উপন্যাস রচনার কাছাকাছি সময়ে। রবীন্দ্রনাথের অঙ্কিত এই পর্বের দুএকটি মুখাবয়বে কল্পনার প্রাধান্য লক্ষণীয়।

বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার অমিত রায় প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত এবং রোমান্টিক যুবক। তর্কে প্রতিপক্ষকে হারাতে সিদ্ধহস্ত। এই অমিত একবার শিলং পাহাড়ে গেল বেড়াতে । আর সেখানেই এক মোটর দুর্ঘটনায় পরিচয় ঘটল লাবণ্যর সাথে। যার পরিণতিতে এল প্রেম। কিন্তু অচিরেই বাস্তববাদী লাবণ্য বুঝতে পারল অমিত একেবারে রোমান্টিক জগতের মানুষ যার সঙ্গে প্রতিদিনের সাংসারিক হিসেবনিকেশ চলে না। ইতিমধ্যে শিলংএ হাজির হয় কেতকী। অমিতের দেওয়া আংটি দেখিয়ে অমিতকে নিজের করে নেয়, ভেঙ্গে যায় লাবণ্যর সাথে অমিতের মালা বদলের স্বপ্ন। একসময় অমিতও স্বীকার করে নেয়, লাবণ্যের সাথে তাঁর ভালবাসা ঝর্ণার মতো, পাত্রে করে ঘরে তুলে আনার মতো নয়। কেতকির ভালোবাসাই পাত্রে নিয়ে পান করা সম্ভব। কিন্তু লাবণ্যর প্রতি ভালবাসা বন্য, নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাবে ঝর্ণার মতো।

পুতুল নাচের ইতিকথা – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

“খালের ধারে প্রকাণ্ড বটগাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়া হারু ঘোষ দাঁড়াইয়া ছিল। আকাশের দেবতা সেইখানে তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন। হারুর মাথায় কাঁচা-পাকা চুল আর বসন্তের দাগভরা রুক্ষ চামড়া ঝলসিয়া পুড়িয়া গেল। সে কিন্তু কিছুই টের পাইল না।”

– এভাবেই শুরু হয় ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রেম, বিরহ, দ্বেষ ও পারস্পরিক সহমর্মিতাকে উপজীব্য করে লেখা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’।

গ্রামীণ জীবনের পটভূমি নিয়েই লেখা ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’। কিন্তু গ্রামীণ জীবন থেকে মানব জীবনের সামাজিক, অর্থনৈতিক আর জৈবিক তাড়নাগুলোই মুখ্য হয়ে উঠেছে এই উপন্যাসে। শশীর ভিন্ন জীবনলাভের ইচ্ছা, কুমুদের অবনতি দেখে তৃপ্তি পাওয়া কিংবা কুসুমকে নিজের করে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা- এসবই উপন্যাসটিকে গল্পের সীমা পেরিয়ে জীবনের দর্পণে নিয়ে এসেছে।

পরিণতির পরেই শেষ আসে। কিন্তু আমরা জানি না শশী কি পৌঁছাতে পারে কিনা তার লক্ষ্যে। জানি না কুমুদ কি ভালবাসতে পারে মতিকে, নাকি খানিক মোহ শেষে আবার ছুটে যাবে তাঁর দুরন্ত পথে। জানি না কুসুম, বিন্দু কিংবা গোপাল দাসই বা কোথায় গিয়ে ঠেকবে। শুধু একটা প্রশ্নের উত্তরই জানি। পুতুলনাচ থেমে থাকে না, থামবেও না। পুরানো পুতুল ভেঙ্গে গেলে নতুন চকচকে পুতুল তার জায়গা করে নেয়। তবু, পুতুল নাচ চলতেই থাকে…চলতেই থাকে।

আরও পড়ুন: নিজের জীবন দিয়ে অধিকাংশ যাত্রীর প্রাণ বাঁচালেন বায়ুসেনার পুরস্কৃত পাইলট

তিতাস একটি নদীর নাম – অদ্বৈত মল্লবর্মণ

“তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।”

এ কথাগুলো ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসের শুরুতে লিখেছিলেন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। বাংলা সাহিত্যে নদীকেন্দ্রিক উপন্যাসের মধ্যে নিম্নবর্গীয় মানুষের আখ্যানসমৃদ্ধ ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ অমরকীর্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। নদী অববাহিকায় বসবাসরত মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এ উপন্যাসে। ‘ধীবর’ বা ‘মালো’ সম্প্রদায়ের মানুষ হিসেবে অদ্বৈত মল্লবর্মণ গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে দেখেছেন এ সমাজের জীবনসংগ্রামের নিষ্ঠুর চিত্র। বলা যায়, প্রতিকূল সংঘাতে ক্রমে মুছে আসা ‘মালো’ জীবনের সারাৎসার তিনি আঁকতে সক্ষম হয়েছেন এ উপন্যাসে।

গণদেবতা – তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়

গণদেবতা উপন্যাসের সময়কাল ১৯২৬ সাল থেকে পরবর্তী আরও একদশক পর্যন্ত বিস্তৃত, যে সময়টা ছিল বড্ড  ঘটনাবহুল একটা সময়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ জগৎ, সমাজ, সংসারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। সেই আগুনে জ্বলছে শহর, গ্রাম সব। অভাব আর ক্ষুধা মানুষকে পিষে ফেলছে।বাইরের দুনিয়ার অস্থিরতা থেকে মুক্তি পায়নি কালিকাপুর গ্রাম। অস্থিরতা প্রভাব ফেলেছে গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনেও। নতুন আর পুরাতনের মধ্যেকার লড়াই  দ্বিধাবিভক্ত করে দেয় সরল শান্তিপূর্ণ গ্রাম্য জীবনকে।

অভাবের তাড়নায়, রোজগার আশায় গ্রামের কামার অনিরুদ্ধ থেকে ছুতার গিরিশ সকলে গ্রামের ব্যবসা গুটিয়ে শহরের পথে। এই ধারাবাহিকতায় উত্থান হয় গল্পের নায়ক দেবনাথ ওরফে দেবুর। দেবুর স্ত্রী বিলির জীবনে আমুল পরিবর্তন এলো। এলো অনি কামারের বৌ পদ্মর জীবনে। পাশাপাশি যুদ্ধের বাজারে একদল সুযোগসন্ধানী লোকের আবির্ভাব হল, যারা গরিবের ঘাড়ে পা রেখে তাড়াতাড়ি বড়লোক হয়ে আর মাটিতে পা ফেলতে চাইলো না। এইসব চরিত্রগুলি নিয়ে গড়ে উঠেছে গণদেবতা উপন্যাস। যেখানে লেখক তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় গ্রামের মানুষের জীবনের হঠাৎ বাঁক বদলের কথা সুচারুরুপে ফুটিয়ে তুলেছেন।

শ্রীকান্ত – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

“মরার আবার জাত কি!”

শ্রীকান্ত উপন্যাসের এই সহজ সরল বাক্যটিই মানব গোষ্ঠীর পরম আকর। ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাস প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৭ সালে। দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৮ সালে, তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল একটু দেরীতে ১৯২৭ সালে এবং চতুর্থ বা শেষ খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৩ সালে। আজকের সময়ের দিকে তাকিয়ে প্রায় একশ বছর আগে বিশাল আকারের উপন্যাস লিখেছিলেন শরৎচন্দ্র। সেই কালে সনাতন ধর্মের ভেতরে জাত-পাতের যে বিষাক্ত বিস্তার ছিল, সেই অন্ধকার কালে একটি উপন্যাসের চরিত্রের মুখ দিয়ে এমন সরল কিন্তু চিরকালের একটি মানবিক বাক্য প্রকাশ করাও ছিল দুঃসাহসের পরিচায়ক।

চারটি খণ্ডে প্রকাশিত এই উপন্যাসে অনেক চরিত্র, উপ-চরিত্র, আখ্যান, উপ-আখ্যান তিনি তৈরি করেছেন। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র শ্রীকান্তের জীবন-অভিজ্ঞতা বর্ণনাচ্ছলে এতে বিচিত্র ঘটনা ও অসংখ্য নরনারীর সমাবেশ ঘটেছে। সেসব ঘটনা ও পাত্রপাত্রীর বাহুল্যের মধ্যেও উপন্যাসের মূলসূত্র শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মীর প্রণয়-কাহিনী শেষ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মীর পাশাপাশি শ্রীকান্তের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রথম পর্বের ইন্দ্রনাথ ও অন্নদাদিদি, দ্বিতীয় পর্বের অভয়া, তৃতীয় পর্বের ব্রজানন্দ ও সুনন্দা এবং চতুর্থ পর্বের গহর ও কমললতার হার্দিক ও সামাজিক সম্পর্কের বহু বর্ণিল বিষয় এতে চিত্রিত হয়েছে। সেই সঙ্গে তৎকালীন বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থারও একটি বাস্তবানুগ চিত্র এতে অঙ্কিত হয়েছে। শ্রীকান্ত চরিত্রটির মধ্য দিয়ে লেখকের ব্যক্তিজীবন বহুলাংশে প্রতিফলিত হয়েছে বলেই গবেষকগণ মনে করেন।

বাংলা সাহিত্য হচ্ছে রত্নগর্ভা। যুগ যুগ ধরে কত অনন্য, অদ্বিতীয় উপন্যাসের সে জন্য দিয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না। আজ এ পর্যন্তই, আগামি পর্বে আলোচনা করা হবে আরও সেরা পাঁচ উপন্যাসের।

আরও পড়ুন: Beauty with Brains: মিস ইন্ডিয়ার মঞ্চ মাতানোর পর UPSC তালিকাতেও স্থান করে নিলেন ঐশ্বর্য

 

 

 

 

Exit mobile version