Site icon The News Nest

Book Review: গালিব আর মান্টো মিলেছেন ‘দোজখনামা’য়, ইতিহাস কথা কয় এই বইয়ে

WhatsApp Image 2022 12 31 at 10.13.08 AM

মেহনাজ পারভিন

“মৃত্যুকে সহ্য করা যায় শফিয়া। স্মৃতিকে নয়। জীবনের অনেক বড় আঘাত আমরা সহ্য করতে পারি, তারপর হয়ত মনেও থাকে না। কিন্তু এক-একটা লেখা এসে বারবার আমাদের কাঁদায়। লেখার ভেতরে তো স্মৃতি ছাড়া আর কিছু থাকে না।” (Book Review)

দুই শায়ের। দেশ-কাল-সময় ভিন্ন। মুঘল আমলের শেষের দিকে আবির্ভাব শায়ের মির্জা গালিবের। আর দেশ ভাগের আগে আর্বিভাব সাদাত হোসেন মান্টোর। দু’জনের মধ্যে তফাত প্রায় একশো বছরের। কিন্তু বেদনার কোনও এক তন্ত্রীতে বাঁধা পড়েছে দুজনের মন। তাই লেখক রবিশঙ্কর বল ‘দোজখনামা’ উপন্যাসে তুলে ধরেছেন তাদের কথোপকথন। যে কথোপকথনে আমরা জানবো তাঁদের সময়ের কথা। যা আমাদের অদেখা, অন্য ভুবনের গল্প। তাঁদের দুজনের জীবনকথার মাঝে মাঝে মুক্তোর মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য শের।

সাহিত্যের ইতিহাসে অন্যতম দুই ছন্নছাড়া পাগলাটে মানুষ। কবি গালিবের মনের গহনে ছিল পূর্বপুরুষের জাঁহাবাজ দুর্দান্ত রক্তের ছলকানি, মান্টোর ভেতরে ছিল কাশ্মিরি হাওয়া, স্বাধীনতার পিপাসা। এরকম দু’জন মানুষকে নিয়ে গল্প লেখা হয়, তখন নিশ্চিত ভাবে সেখানে উঠে আসে সেই দু’জন মানুষের কাল। তাদের সমসাময়িক সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থা। ইতিহাসের একটা দলিল।

দোজখনামা বইটির পরতে পরতে আবেগ আর অনুভূতির খেলা। কী আবেগ নেই সেখানে! কখনও প্রেমের প্রবল উচ্ছ্বাস, কখনও বা সম্পর্ক শেষের ব্যথা। একাকীত্ব, সংগ্রাম, হাহাকার, জীবনভর খুঁজতে থাকা হারানো সত্তা, প্রেম, দুঃখ, ধর্মবিশ্বাস, রাজনীতি এসবই চলেছে পুরো বইজুড়ে। গালিবের বুকে আঁকা নিজের প্রিয় শহর শাহাজাহানাবাদের ধ্বংসলীলা। চোখের সামনে দেখেছেন ইংরেজদের অত্যাচার। শহরে থেকেও মৃতের স্তূপে বাস করতে হয়েছে দিনের পর দিন। অন্যদিকে মান্টোর বুকে ভারতভাগের তীব্র যন্ত্রণা। প্রিয় শহর বোম্বেকে ছেড়ে লাহোর চলে যাওয়ার কষ্ট আজীবন বহন করেছিলেন তিনি। সেই হিসাবে বলতে গেলে -মূল সুর দু’জনেরই এক। সেই কষ্ট থেকেই তাঁরা দিনের পর দিন রচনা করে গিয়েছেন গজল, শের আর গল্প।

আরও পড়ুন: Mamata Banerjee’s Books: বইমেলায় প্রকাশিত ১২ বই, ‘ট্রেডমিল করতে করতেই ব্রিফিং দিই’; বললেন মমতা

লাহোরে মান্টো অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন নিজের লেখার জন্য। অন্যদিকে গালিব বেঁচে থাকার জন্য নিজেই নিজের লেখা বিকৃত করেছেন। বারবার সম্পর্ককে জড়িয়েছেন দুই ‘শায়ের’ আর সেই সম্পর্ককে পূর্ণতা দিতে না পেরে হতাশায় ডুবে গিয়ে শব্দসৃষ্টির উল্লাসে মেতে উঠেছেন। জন্ম দিয়েছেন নতুন লেখার। বর্ণময় জীবন দু’জনেরই। ঘটনার ঘটঘটায় আচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে তার ছটায় চোখ ধাঁধিয়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু শেষ জীবনে এসে দু’জনেই আবার একা, অসহায়, নিঃসঙ্গ। সহায়সম্বলহীন। যাঁরা অগণিত গজল লিখে গিয়েছেন জীবনভর, তাঁদের জীবনও এক-একটা গজলই। তবে সে গজলের সুর বড় করুণ। ছিঁড়ে যাওয়া তারের শেষ শব্দটুকু দিয়েই হয়তো ব্যাখ্যা করা যায় গালিব আর মান্টোর জীবনকে। তবু সে ব্যাখ্যা কোথাও গিয়ে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। রামধনু রঙে আঁকা দু’টি জীবনকে এককথায় ব্যাখ্যা করতে যাওয়া সত্যিই অসম্ভব।

‘দোজখনামা’ নামটি একদিক থেকে সার্থকই বলা যায়। দোজখ্ শব্দের অর্থ নরক। গালিব ও মান্টো বেঁচে থাকতে-থাকতেই নরকবাস করেছেন। কখন বা প্রিয়জনকে হারিয়ে, কখনও বা প্রেয়সীকে হারিয়ে আর কখনও সন্তানসম শব্দদের হারিয়ে। পাওয়ার তুলনায় হারানোর দাঁড়িপাল্লা ভারী দু’জনে জীবনে। তাই এই গল্প যত না বেশি তাঁদের বেঁচে থাকার, তার থেকে অনেক বেশি তাঁদের নরক যাত্রার। তবু সে যাত্রাকে ভালোবেসেছেন বলেই ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছে গালিব ও মান্টোর সৃষ্টি। জীবন ভালোবেসে দু’জনেই বলেছেন, ‘বাসনার নিত্য রঙের দর্শক আমি,/আমার বাসনা পূর্ণ হবে কি না/ অবান্তর সে কথা।

বই: দোজখনামা
লেখক : রবিশঙ্কর বল
প্রকাশক: দে’জ পাবলিশিং

আরও পড়ুন: Surjotamosi Review : চাইনিজ গুপ্তসঙ্ঘ, ফ্রি ম্যাসন, কালোজাদু – রহস্যের ঘনঘটা উনিশ শতকের ‘কলিকাতা’য়

Exit mobile version