Site icon The News Nest

করোনা আতঙ্কেও ওরা নিশ্চিন্তে…

তাজিন আহম্মেদ

যখন পুরো বিশ্ব করোনা আতঙ্কে আতঙ্কিত তখন ওরা কিন্তু নিশ্চিন্তে। ওদের জীবনে নেই কোনো ভয় নেই কোনো আশঙ্কা, কারণ ওদের কাছে এ বার্তা পৌঁছে দেবার কোন মাধ্যম নেই । ওরা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে পৃথিবীর বুকে আসছে বড়ো হচ্ছে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য টুকু সংগ্রহ করছে স্বাভাবিক নিয়মেই জুটি বাঁধছে বংশ বিস্তার করছে আবার প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে চলেও যাচ্ছে । ওদের এই স্বাভাবিক জীবন যাত্রা দেখার সুযোগ ওরা নিজেই আমাকে করে দিয়েছে । আসলে আজ আমি এক জোড়া কবুতর জুটির গল্প শোনাবো । ওরা কেউ আমার পোষ্য নয়।

এই লকডাউন যখন শুরু হয় তখন প্রথম দিকটায় আমিও ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে ছিলাম । সারাক্ষণ বোকা বাক্সোটার সামনে বসে বসে বোকার মতো নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলাম । ঠিক তখনি বেশ কিছু ভালো এবং অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল আমার সঙ্গে । এ তাদেরই মধ্যে একটা ঘটনা ।

আরও পড়ুন: মাত্র ৫০ টাকায় ডায়ালিসিস! গরিবদের সুস্থ হয়ে ওঠার ভরসা দিচ্ছেন ফুয়াদ ডাক্তার

আমার বাড়ির উত্তরের জানালাটা আমার বড়ো প্রিয় । খুব শখ করে সেখানে ঝুলন্ত গ্রিল বানিয়েছি গাছ লাগাবো বলে । কিন্তু সে শখ মনের মধ্যেই গেঁথে রাখতে হয়েছে । কারণ ঐ জায়গাটা আমার যতো খানি প্রিয় ততখানিই প্রিয় নানা ধরনের পাখিদের । আসলে ঐ স্থানটি ওদের বিনোদনের স্থান, ঠিক যেন একটুকরো পার্ক। ওরা দিনের নানা সময় এসে একবার করে ঘুরে যায় । কেউ হয়তো একটু বসে বিশ্রাম নেয় আবার কেউ কথাও যাওয়ার আগে একবার একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার নিজের গন্তব্যের দিকে পাড়ি দেয়। আবার কখনো কখনো জোরায় এসে প্রেমালাপ শুরু করে। তবে ঘুরতে এসে একটু খাওয়া দাওয়া না করলে হয়? তাই তো আমার শখ করে টবে লাগানো গাছের কচি কচি পাতা গুলো তাদের সে ইচ্ছা পূরণ করে। সে গুলো হয়ে ওঠে ওদের বাটাটাপুরি ভেলপুরি ফুচকার স্টল । আবার কখনো কখনো এই ছোট্ট গাছের নরম ডাল গুলো হয়ে ওঠে ওদের দোলনা। এই ছোট্ট নরম ডাল গুলো তে বসে দুলতে দুলতে একে অপরের দিকে চাউনিতে প্রেম বিনিময় করে। তার ফলস্বরূপ আমার ছোট্ট নরম গাছ গুলো বেড়ে উঠতে তো পারেই না, বেশির ভাগ সময় মারা যায়। তাই অগত্যা বাধ্য হয়ে আমি ঐ স্থানটি ওদের কেই সঁপে দিয়েছি। আর সেখানে রেখেছি কিছু অ্যালভিরা এবং পাতা বাহারের গাছ। সে গুলোর বিশেষ ক্ষতি ওরা করে উঠতে পারে না ।

এমনি একদিন এক জোড়া কবুতর জুটি বেঁধে এসে প্রেমালাপ শুরু করল । কিছু ক্ষণ পরে দেখলাম একজন একটা পাতাবাহার গাছের টবে গিয়ে বসে পড়ল আর অন্য জন একটু উপরে গ্রিল থেকে তাকে লক্ষ্য করতে লাগল । আমি অবশ্য খুব একটা গুরুত্ব দিলাম না কারণ এ ঘটনা তো প্রায় দেখি । তারা কিন্তু এমনটি রোজই শুরু করল । এর পর দুই থেকে তিন দিন পর গাছে জল দিতে গিয়ে দেখি একটা ডিম ।অবাক হয়ে গেলাম, মনে মনে ভাবলাম একি ওরা তো রোজই দেখছে আমি রোজ গাছে জল দি। তাছাড়া এই লকডাউনের সময় আমার ছেলের দিনের একটা লম্বা সময় কাটে ঐ জানালাতেই। তার পরও ওরা সাহস করলো কি ভাবে? একবার একটু নেড়েচেড়ে দেখলাম ডিমটাকে । পরক্ষণেই ভাবলাম ওরা যখন বিশ্বাস করে ওদের সন্তানকে এখানে রাখতে পারে তখন আমিই বা বাঁধা দিই কেন?
এরপর শুরু হল আগত ছানার অভিভাবকদের দায়িত্ত ও কর্তব্যের পরীক্ষা । না তারা সেখানে বিফল হয়নি । একটানা পুরো আঠারো দিন ধরে দিন রাত্রি এক করে মা বাবা পালা করে ঐ ডিমের প্রতি তাদের কর্তব্য পালন করেছে ,দায়িত্ব নিয়ে আগলে রেখেছে সমস্ত দুর্যোগ থেকে । অবাক হয়ে দেখেছি মা একটা পুরো দিনের অধিকাংশ সময়টাই ডিমটাকে আগলে বসে থেকেছে। শুধু দু-একবার কোথাও উড়ে গেছে হয়তো খাবারের সন্ধানে তাও তাকে একরকম জোর করে তার পুরুষ বন্ধুটি তুলে দিয়েছে হয়তো কিছুটা সময় বিশ্রাম নেবার জন্য। তবে পুরুষ বন্ধুটি মাঝেমধ্যেই উড়ে গেছে ঐ হয়তো খাবারের সন্ধানে তবে সঙ্গে বয়েও এনেছে তার প্রিয় সঙ্গিনীর জন্যও কি কর্তব্যের প্রতি দায়িত্ব পরায়ণ।
আমরা ডিমটাকে দেখার পর প্রথম দুই তিনদিন ওদের কাছাকাছি যাইনি , কারণ মনে হচ্ছিল যদি ভয় পেয়ে উড়ে যায় । কিন্তু দুই দিন পরে মনে হলো এটা নিশ্চয় হবে না কারণ ওরা তো সবটা জেনে বুঝেই এসেছে । তাই একটু সাহস করে ওকে খেতে দেওয়ার অছিলায় ওর কাছে গেলাম । হ্যাঁ আমি সফল হলাম । ও উড়ে গেল না শুধু একটু সরে গিয়ে সিটকে থাকল। আমার দেওয়া খাবারটা খেয়ে ছিল কিন্তু জলটা খায়নি ।শুনে আমার ছেলের তো মহা খুশি। কারণ ঐ জানালাটার কাছাকাছি না যেতে পারাটা ওর জন্য রীতিমতো শাস্তি পাওয়ার সামিল। আসলে এই লকডাউনের সময় ঐ জানালাটার মাধ্যমেই তো সে বাইরের জগতের সঙ্গে যুক্ত ।

এতে অবশ্য আরো একটা সুবিধাও হয়ে গেল । আমার ছেলে সময় কাটানোর আরো একটা বিষয় পেয়ে গেল। আগে তার কাছে দিনভর রাস্তায় কি কি ঘটছে পুলিশ কাকুরা কি ভাবে মানুষকে বোঝাচ্ছেন আরো নানা তথ্য পাচ্ছিলাম। এখন ঐ সঙ্গে এই যুগলের নানা তথ্য পেতে লাগলাম। আমরা কর্তা-গিন্নী চিনতে পারতাম না কোনটা বাবা কোনটা মা, ও চিন্ত। একদিন আমাকে একটা পাখির পালকের একটা অংশ দেখিয়ে বলল দেখ এটা মা। তখন অতটা বিশ্বাস না হলেও রাত্রে যখন ওকেই ডিম আগলে বসে থাকতে দেখলাম তখন মনে হলো হয়তো ঐ ঠিক । হ্যাঁ আরো একটা মজার ব্যাপার হলো আমরা ওদের ক্রিয়া কলাপ দিন রাত্রি দুটো সময়েই ভালো ভাবেই দেখতে পাই, কারণ ওর বর্তমান বাসস্থান আমার বিছানা থেকে হাত দেড়েক দূরেই। আমার আবার একটু পড়তে লিখতে খুব ভালো লাগে ,আর সেটা রাত্রের নিস্তব্ধতায় ভালো হয় । তাই নিজের কাজের সঙ্গে ওকেও দেখাটা খুব সুবিধার। এ ক্ষেত্রে আমি ওর বা ওকে বলছি এ কারণেই রাত্রে শুধু একজন পাহারাদার থাকে আর অন্য জন থাকে অন্য কোথাও। আমি যেমন ওকে লক্ষ্য করি তেমনি সেও কিন্তু আমাকে লক্ষ্য করে। আমি বিছানা থেকে পা নীচে করলেই সে উড়ে না গেলেও একটু শক্ত হয়ে মাথা উঁচু করে আমাকে যেন শাসিয়ে বলে সাবধান ভেবনা আমি ঘুমিয়ে পড়েছি এই সুযোগে আমার সন্তানের কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করবে না। আমার হাসি পায় ।

আরও পড়ুন: কোয়ারেন্টাইন কারে কয়, সেকী কেবলই যাতনাময় ?

ও রাত্রে সারাক্ষণই সজাগ থাকে, কারণ আমি লাইট নিভিয়ে শুতে গেলে তখনও তাকে দেখতে পাই দেওয়ালে পড়া ছায়া থেকে। অনেক সময় কোনো সেন্দহজনক কিছু লক্ষ্য করলে বা শব্দ পেলেই ওমনি সজাগ হয়ে খাড়া হয়ে বসে। আমি মুগ্ধ হয়ে ভাবি এবং গর্ব বোধ করি সব মা রাই সন্তানের ব্যাপারে সদা সজাগ। এমনি করে একটা একটা দিন পার হতে লাগল । এর মধ্যে ঘটে গেল আরো অনেক ঘটনা । একদিন রাত্রে খুব ঝড় বৃষ্টি হল। আমার বর বেচারা চিন্তিত হয়ে পড়ল। ও চাচ্ছিল টবটা ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে নিতে। কারণ ওর মনে হচ্ছিল এই জলে ওর অসুবিধা হবে, ডিমটাও জলে ডুবে যাবে। আমি বাধা দিলাম ওকে বোঝালাম ” দেখ, এখন যদি ওকে ওখান থেকে ওঠাতে যায় ও ভয় পেয়ে উড়ে যাবে তাতে ভিজবেতো অবশ্যই, আর যদি কোনো বেড়াল বা অন্য কোন শিকারির সামনে পড়ে যায় তাতে বিপদ হয়ে যাবে । আর ওরা প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই বেঁচে থাকতে জানে। ও ভালো ভাবেই জানে এই পরিস্থিতিতে ওর কি করা উচিত । ওকে ওর মতো থাকতে দাও।”

হ্যাঁ, সত্যি সে রাত্রে ওদের কিচ্ছু হয়নি । এমনই ছোট ছোট নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে অবশেষে আসল সেই দিন, যে দিনটির অপেক্ষায় আমরাও ছিলাম ওরাও ছিল। আমার ছেলের মনে সব থেকে বড় প্রশ্ন ছিল। “কবে বাচ্চা হবে?” ওর বাবা উত্তর দিত মোটামুটি কুড়ি থেকে একুশ দিন সময় লাগবে। মোটামুটি ঐ সময়ের কাছাকাছি মানে পুরো আঠারো দিন পর সেই দিনটি আসল। ঐ দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই খুশিতে ডগমগ হয়ে ছেলে এসে খবর দিল মা বাচ্চা হয়েছে । গিয়ে দেখি মা আরো একটু গুছিয়ে বসে আছে সে কিছুতেই বিনা মুখদেখাই তার বাচ্চা দেখতে দেবে না । অগত্যা অনেক অনুনয় বিনয় করে অবশেষে দেখা মিললো সেই একরত্তি ছোট্ট প্রাণের । হালকা হলুদ চোখ না ফোটা নতুন প্রাণের। ক্ষণিকের জন্য মনে হয়েছিল আর ভয় নেই এই তো এসে গেছে সেই স্বর্গীয় বার্তা নতুন জীবনের বার্তা।

আরও পড়ুন: অসুস্থ বাবাকে সাইকেলে চাপিয়ে ১২০০ কিমি পার! ‘সুপার ৩০’-র অফার, বিহারের কিশোরীর গল্প আসছে রূপোলি পর্দায়

তবে কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ঐ নতুন ছোট্ট প্রাণটি মায়ের স্নেহে মায়ের যত্নে মায়ের কোলেই লুকিয়ে থাকলো আরো তিনদিন। তিনিদিন পর একটু চোখ খুললে, কিন্তু কোনো গলার শব্দ পায়নি । এরপর ঐ দিন ভোর বেলা একটা কাকের কর্কশ আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় । আসলে এই জানালাটাই কেন জানি না অন্য পাখি আসলেও কাক খুব একটা আসে না । তাই একটা অশুভ সংকেতের আভাসে ছুটে গিয়ে দেখি না বাচ্চাটা ঠিক আছে কিন্তু মা ভীষণ অস্থির । একটা লাঠি দিয়ে কাকটাকে তাড়া করতেই মা শান্তি পেল। ঠিক তার পরের দিনই গভীর রাত্রে আমার ঘুম ভেঙে যেতেই দেওলের পড়া ছায়ার মধ্যে দেখতে পাই দুটো মাথা যেন বড্ড বেশি নড়াচড়া করছে। ভয় পেয়ে লাইট জ্বালিয়ে ছুটে গিয়ে দেখি ওমা এতো মা ও সন্তানের সব থেকে আনন্দময় মুহূর্ত । সন্তান মাথা উঁচু করে করে মায়ের কাছে আদর নিতে চাচ্ছে আর মাও তাকে ঠোঁট দিয়ে চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিচ্ছে ওর পুরো শরীর । ওদের মা সন্তানের এই জগত শ্রেষ্ঠ সুন্দর মুহূর্তটা দুচোখ ভরে মনের গভীরে বন্দী করে রাখলাম ,কিন্তু তাকে ক্যামেরা বন্দী করি নি ভাবলাম এখন থাক দিনের বেলা এমন সুযোগ পেলে তখন না হয় ক্যামেরা বন্দী করবো । কিন্তু আফসোস ভোরের বেলা উঠে দেখি পুরো পরিবারটাই উধাও । আমরা অবাক হয়ে গেলাম গেল কোথায় বাচ্চাটা কি কাকে নিয়ে চলে গেল? তবে কিছু টের পেলাম না কেন, মা তো নিশ্চয়ই বাধা দিতে ছটফট করতো? কিন্তু কই শব্দ তো কিছু হয় নি?

না, মনখারপ করা ছাড়া কোনো উত্তর আমাদের কাছে ছিল না । আমরা তিনজন মিলে সারা দিন ভোর উঁকি ঝুঁকি মেরে এদিকে ওদিকে দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম । আমার ছেলে ছাদে থেকেও দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু না সব জায়গা থেকে নিরাশই হতে হলো । ভীষণ ভাবে মন খারাপ হয়ে গেল আমাদের । কিন্তু ঠিক দুই দিন যেতে না যেতেই আবার এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে গেল । আবারো দুইজন একই ভাবে ফিরে এলো। আমরা খুশি হলাম যাক বাবা ওরা ফিরে এসেছে কিন্তু বাচ্চাটা দেখতে পাচ্ছিলাম না । ভাবলাম হয়তো উপরের দিকে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে ।

কিন্তু একি ঠিক দুই থেকে তিন দিন পরে আবারো আমরা হতবাক ঐ একই স্থানে আবার একটা ডিম এটা কি করে সম্ভব । ছেলে ভালো করে লক্ষ্য করে বলল ওমা এ পাখিটা তো আগেরটা নয় । বিশ্বাসটা আরো গাঢ় হল ঠিক একদিন পর যখন ছেলে দেখাল ঐ স্থানে দুটি ডিম । এখন আবার শুরু নতুন অভিভাবকদের দায়িত্ত ও কর্তব্যের পরীক্ষা ।

https://www.thenewsnest.com/wp-content/uploads/2020/05/WhatsApp-Video-2020-05-31-at-7.08.58-PM-1.mp4

আজ প্রকৃতি প্রতি ক্ষণে ক্ষণে সমস্ত মানুষ সমাজকে বুঝিয়ে দিচ্ছে তোমরা যতই হিসেব কষে চলো বিজ্ঞানে উন্নতি আনো প্রকৃতি চলে আপন ছন্দে। তার কাছে নত হতে তার কাজে মুগ্ধ হতে তোমরা বাধ্য । আরো একটা অত্যন্ত মূল্যবান বার্তা এই দাম্ভিক গর্বিত সমাজকে পৌঁছে দিচ্ছে তাদের সামনে একটা স্বচ্ছ আইনা তুলে ধরে জানিয়ে দিচ্ছে তোমরা যা নিয়ে গর্ব করো তার কোনোটাই তোমাদের নয় । তোমরা শুধু মাত্র কারিগর । যেমন এর বুকে একা এসেছো কাজ শেষে একাই ফিরে যেতে হবে । কিচ্ছুটি নিয়ে যেতে পরবে না ।

আরও পড়ুন: রমজানের ঐ রোজার শেষে’ এবং নজরুল ইসলাম, রইল কিছু অজানা কথা…

Exit mobile version