কথাসাহিত্যের এক প্রবাদপ্রতিম নক্ষত্রের নাম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। পূর্ববাংলা ও বাংলাদেশের সাহিত্যে তিনি পথ দেখিয়েছেন, গড়ে তুলেছেন স্বতন্ত্র এক ভাষারীতি। যে ভাষা, যে কাহিনী বিন্যাস, চরিত্রের সৃষ্টির সাথে আর কোনো ভাষা সাহিত্যিকের সাহিত্য কর্মের মিল পাওয়া যায় না। বিষয়, কাঠামো ও ভাষা-ভঙ্গিতে নতুন এক ঘরানার জন্ম দিয়েছেন তিনি। ধর্মীয় গোঁড়ামি, ভন্ডামি, কুসংস্কারকে ব্যবচ্ছেদ করেছেন তিনি তার লেখায়।
যার হাতে জন্ম নিয়েছে লালসালু, কাঁদো নদী কাঁদো, চাঁদের অমাবস্যার মতো উপন্যাস, নয়নচারা, দুই তীর ও অন্যান্য গল্প এর মতো গল্পগ্রন্থ কিংবা বহিপীর এর মতো নাটকের জন্ম। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে বলা যায় বাংলাদেশের সাহিত্যে আধুনিক গদ্যের জনক। তিনি নিজে পাঠককে প্রভাবিত করেছিলেন তো বটেই, তার সাহিত্য দিয়েই প্রভাবিত করেছেন অসংখ্য সাহিত্যিককেও। তার সাহিত্য প্রভাবিত করেছে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির, মামুন হুসাইন, শাহাদুজ্জামান এর মতো সাহিত্যিকদেরও। অনেকে তাকে বলে থাকেন বাংলাদেশের সাহিত্য চর্চার ইন্সটিটিউট।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জন্মেছিলেন চট্টগ্রামের ষোলশহরে, ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট। বাবা সৈয়দ আহমাদুল্লাহ ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা, মা নাসিম আরা খাতুনও ছিলেন সমতুল্য উচ্চশিক্ষিত ও রুচিশীল পরিবার থেকে উঠে আসা। মাত্র ৮ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। দুই বছর পর তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর শৈশব ও কৈশোর কাটে বাবার চাকরির সূত্রে দেশের নানা প্রান্তে। কখনো মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফেনী, ঢাকা, নদীয়ার কৃষ্ণনগর, হুগলী, চুঁচূড়া, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, কখনো বা ময়মনসিংহ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরী ছিলেন সহপাঠী। বিশেষ করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বাবা যখন ১৯৩২- ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত মানিকগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন তখন বুলবুল চৌধুরীর বাবা আজমুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন মানিকগঞ্জের কোতোয়ালি থানার পুলিশ অফিসার।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্য চর্চার ও ছবি আঁকার ঝোঁক ছিল শৈশব থেকেই। তার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় হাতেখড়ি হয় মানিকগঞ্জের একটি স্কুলে। এরপর মুন্সিগঞ্জে কিছুদিন পড়ে বাবার চাকরির সুবাদে তাকে চলে আসতে হয় ফেনীতে। ফেনী হাইস্কুল (এখন ফেনী সরকারি পাইলট হাইস্কুল) এ ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। তিনি যখন ফেনী হাইস্কুলে ভর্তি হন এর কিছুদিন পর ফেনী হাইস্কুলে হাউজ সিস্টেম চালু হয়। সেই হাউস থেকে বের হতো হাউজ ম্যাগাজিন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর হাতে প্রতিষ্ঠিত সেই হাউজ ম্যাগাজিনের নাম রেখেছিলেন ‘ভোরের আলো’। চট্টগ্রাম জেলা স্কুলেও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কিছুদিন পড়েছিলেন। তবে তিনি ম্যাট্রিক পাশ করেন কুড়িগ্রাম হাইস্কুল থেকে ১৯৩৯ সালে। এরপর তাকে ভর্তি করানো হয় ঢাকা কলেজে। থাকতেন ঢাকা কলেজের হোস্টেলে।
ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে পড়া অবস্থায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম গল্প ‘সীমাহীন এক নিমেষে’ ছাপা হয়েছিল ঢাকা কলেজ ম্যাগাজিনে। ঢাকা কলেজ ম্যাগাজিন তখন দেখতেন বিখ্যাত দুই অধ্যাপক। প্রাবন্ধিক কাজী আবদুল ওদুদ ও পরিমল কুমার বসু।
ঢাকা কলেজে পড়ার সময় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সহপাঠী ছিলেন মোহাম্মদ তোয়াহা। তোয়াহা ও ওয়ালীউল্লাহ একই হোস্টেলে থাকতেন। একবার মোহাম্মদ তোয়াহা ভীষণ ইনফ্লুয়েঞ্জাতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। পরিবার পরিজনহীন হোস্টেলের রুমে শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছেন তিনি। তাদের ঢাকা কলেজের আরেক সহপাঠী সৈয়দ নুরুদ্দিন, লিখেছিলেন ঢাকা কলেজ স্মৃতিগ্রন্থে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ যখন ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন সে বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ ছেড়ে ঢাকা কলেজের প্রথম মুসলিম অধ্যক্ষ হয়েছিলেন ড. মমতাজউদ্দিন আহমদ।
ঢাকা কলেজে থাকা অবস্থাতেই ঢাকার প্রগতি লেখক সংঘের সক্রিয় কর্মী হয়ে গিয়েছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লহ্। সোমেন চন্দ ছিলেন প্রগতি লেখক সংঘের আরেক সক্রিয় কর্মী। এ সময় ঢাকা কলেজের অধ্যাপক কাজী আবদুল ওদুদ, পরিমল কুমার ঘোষ ও কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন প্রগতি লেখক সংঘের অন্যতম সারথি।
১৯৪১ সালে অনেক বেশি নম্বর পেয়ে প্রথম বিভাগে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। ভীষণ মেধাবী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ইন্টারমিডিয়েট পড়া অবস্থাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন। তাদের মধ্যে মির্জা নুরুল হুদা ও বাসুদেব বসাক। ওয়ালীউল্লাহর বন্ধুরা লিখেছিলেন, তার অর্থনীতিতে বা ইংরেজিতে অনার্সে পড়ার ভীষণ ইচ্ছে ছিল। মির্জা নুরুল হুদা তো পরবর্তীতে পুর্ব পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী এবং গভর্নরও হয়েছিলেন। ঢাকা কলেজে অর্থনীতি নিয়ে বিএ তে ভর্তি হয়েছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। কিন্তু বাবার চাকরির সুবাদে কিছুদিন পর তাকে ময়মনসিংহ চলে যেতে হয়েছিল। তার বাবা তখন ছিলেন ময়মনসিংহ সদর দক্ষিণের মহকুমা প্রশাসক। পরবর্তীতে তিনি অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও হয়েছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ভর্তি হলেন আনন্দমোহন কলেজে। সেখান থেকে ডিসটিংকশনসহ বিএ পাশ করেছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। মাঝে কিছুদিন পড়েছিলেন নদীয়ার কৃষ্ণনগর কলেজেও। সেখানে তার শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন শিক্ষাবিদ আবুল ফজলকে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নিয়মিত লেখালেখি শুরু হয় ১৯৪১-৪২ সাল নাগাদ। বিএ পাশ করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কলকাতায় গিয়েছিলেন। ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ তে। ১৯৪৫ এর এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়েছিল সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম গল্প সংকলন ‘নয়নচারা’। কিন্ত জুন মাসে কলকাতায় চিকিৎসা করাতে গিয়ে তার বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক ভরণপোষণ কাঁধে আসায় তাদের দুই ভাইয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়।
ছাত্র অবস্থাতেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল। দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায় চাকরি পেয়েছিলেন তিনি এমএতে পড়ার সময় বাবার মৃত্যুর আগে। দেশভাগের পর তিন দ্যা স্টেটসম্যান পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকা চলে আসেন আর সেপ্টেম্বরে যোগ দিলেন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদক হিসেবে।
এসময়ই তিনি লালসালু উপন্যাস লেখার কাজে হাত দিয়েছিলেন। তখন তিনি থাকতেন পুরান ঢাকার নিমতলীতে। তার পরের বছরই লালসালু উপন্যাস গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছিল কমরেড পাবলিশার্স।
একটা পর্যায়ে রেডিও পাকিস্তানের করাচি কেন্দ্রের বার্তা সম্পাদক হয়েছিলেন তিনি। পরে সেখান থেকে নয়াদিল্লিতে পাকিস্তান দূতাবাসে থার্ড সেক্রেটারির পদমর্যাদায় প্রেস- অ্যাটাশে হন। একই পদে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বদলি হন ১৯৫২-র শেষের দিকে। সিডনিতেই তার পরিচয় হয় আন্-মারি লুই রোজিতা মার্সেল তিবোর সাথে। আন মারি ছিলেন ফরাসী। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তখন পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত, অন্যদিকে আন্-মারি কর্মরত ছিলেন ফরাসি দূতাবাসে। দেড়-দু বছরের সখ্যতা ও ঘনিষ্ঠতা এরপর ১৯৫৫ সালের ৩ অক্টোবর বিয়ে করলেন তারা দুজনে। ধর্মান্তরিত আন মারি’র নতুন নাম রাখা হয় আজজা মোসাম্মত নাসরিন।
এর মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ১৯৫৪ সালে ঢাকায় ফিরে এলেন তথ্য অফিসার হিসেবে ঢাকাস্থ আঞ্চলিক তথ্য-অফিসে। ১৯৫৫ সালে পুনরায় বদলি হন করাচির তথ্য মন্ত্রণালয়। এরপর ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার তথ্য পরিচালকের পদাভিষিক্ত হয়ে, ১৯৫৬ সালের জানুয়ারিতে, দেড় বছর পর পদটি বিলুপ্ত হয়ে গেলে জাকার্তার পাকিস্তানি দূতাবাসে দ্বিতীয় সেক্রেটারির পদমর্যাদায় প্রেস-অ্যাটাশে হয়ে রয়ে গেলেন ১৯৫৮’র ডিসেম্বর অবধি। এরপর ক্রমান্বয়ে করাচি-লন্ডন-বনসহ নানা শহরে, বিভিন্ন পদে ও বিভিন্ন মেয়াদে কাজ করেছিলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। ১৯৬১ সালে ফার্স্ট সেক্রেটারির পদমর্যাদায় প্রেস-অ্যাটাশে হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন প্যারিসের বাংলাদেশ দূতাবাসে। একনাগাড়ে ছয় বছর ছিলেন তিনি এ শহরে। এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছিল লালসালু উপন্যাসটির ফরাসি অনুবাদ “লারব্র্ সা রাসিন”।
কিন্তু একটা পর্যায়ে দূতাবাসের চাকরি ছেড়ে ১৯৬৭ সালের ৮ আগস্ট ইউনেস্কোতে চুক্তিভিত্তিক প্রোগ্রাম বিশেষজ্ঞ পদে প্যারিসের ইউনেস্কো সদর দপ্তরে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইউনেস্কোতে তার চাকুরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে নিয়ম হিসাবে পাকিস্তান সরকার তাকে ইসলামাবাদে বদলিও করেছিল। তবে তিনি ইসলামাবাদে না গিয়ে প্যারিসেই থেকে গিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নিজে প্রচন্ড আর্থিকভাবে সমস্যাগ্রস্ত থাকার পরও বাংলাদেশের জন্য ফ্রান্সে ও ইউরোপে বিশাল অঙ্কের ফান্ড সংগ্রহ করে কলকাতায় মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে পাঠিয়েছিলেন। প্রচার চালিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক মহলে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সময় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ চাকরিহীন, বেকার। তবুও তার ফরাসি স্ত্রী কাজ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রচারর জন্য, বিশ্বমত গড়ে তোলার কাজে।
কিন্তু তার শরীর আর মানলো না। অত্যধিক কাজের চাপ, মানসিক অস্থিরতায় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হলো ওয়ালীউল্লাহর। মুক্তিযুদ্ধের বছরের অক্টোবর মাসে চিরতরে বিদায় নিলেন বাংলা সাহিত্যের এই কিংবদন্তি নক্ষত্র। আজ কিংবদন্তি সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র মৃত্যুদিন। মৃত্যুদিনে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি বাংলা কথাসাহিত্যের এই প্রবাদপ্রতিম মহীরুহকে।