লোকসভায় তাণ্ডবের ঘটনা হঠাৎ করে ঘটানো হয়নি। দীর্ঘ ১৮ মাস ধরে একটু একটু করে ছক কষা হয়, দাবি তদন্তকারীদের। বুধবার বিকেল থেকে অভিযুক্তদের লাগাতার জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, তাতে এখনও পর্যন্ত যে তথ্য হাতে এসেছে, সেই অনুযায়ী, পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে দফায় দফায় আলোচনা সারেন অভিযুক্তরা। ভিন্ রাজ্যের বাসিন্দা হওয়ায়, ঘন ঘন দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি যদিও। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখতেন তাঁরা। ‘ভগৎ সিং ফ্যান ক্লাব’ নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পেজও খোলেন অভিযুক্তরা। (Lok Sabha Security Breach)
বুধবার শীতকালীন অধিবেশন চলাকালীন, জিরো আওয়ারে লোকসভায় তাণ্ডব চালান দুই যুবক। ভিজিটর গ্যালারি থেকে আচমকাই পেল্লায় লাফ মেরে রং বোমা ছুড়লেন দুই যুবক। হলুদ ধোঁয়ায় ভরে গেল সংসদ কক্ষ। ভবনের বাইরে তখন স্লোগান উঠেছে ‘তানাশাহি নেহি চলেগা’। সংসদ ভবনের এই ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে ১৯২৯ সালের কথা। ব্রিটিশ শাসকদের নাড়িয়ে দিতে অভিনব এক পন্থা বেছে নিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগৎ সিং। নিজেদের দাবিদাওয়া ব্রিটিশ শাসকদের কানে তুলতে এমনই এক উপায় বের করেছিলেন তাঁরা। বঙ্গের বটুকেশ্বর দত্ত তৈরি করেছিলেন এমন এক বোমা, যা দিয়ে বিস্ফোরণে ধামাকা হত বিশাল কিন্তু প্রাণহানি হত না। ১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল, সংসদে অধিবেশন চলাকালীন দর্শকের আসন থেকে পরপর এমনই দুটি বোমা ছুড়েছিলেন ভগৎ সিং ও তাঁর সহযোদ্ধারা। সঙ্গে স্লোগান ‘ইনক্লাব জিন্দাবাদ’৷ দাবিদাওয়া লেখা লিফলেটের কাগজ উড়িয়ে দিয়েছিলেন সংসদ কক্ষের ভেতরে। সঙ্গে সঙ্গেই গ্রেফতার হয়েছিলেন দু’জনে। বুধবারের ঘটনার নেপথ্যে এই যোগসূত্রই খুঁজে পাচ্ছেন তদন্তকারীরা।
সংসদ কক্ষের ভেতরে রং বোমা ছুড়ে গ্রেফতার হয়েছেন দু’জন সাগর শর্মা ও ডি মনোরঞ্জন। ভবনের বাইরে স্লোগান তুলে ধরা পড়েন ৪২ বছরের নীলম আজাদ ও ২৫ বছরের অমল শিণ্ডে। বাকি দু’জন যাঁরা ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে ছিলেন ও চারজনকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁরা হলেন বিক্রম ও ললিত ঝা। নীলম হরিয়ানার হিসারের বাসিন্দা। অমল মহারাষ্ট্রের লাতুরের। সাগর শর্মা এবং মনোরঞ্জন ডি কর্ণাটকের৷ তবে তাঁরা আলাদা শহরে থাকেন। চারজনেরই যোগাযোগ ভগৎ সিং ফ্যান ক্লাব থেকে। আলাদা আলাদা শহর থেকে তাঁরা গুরুগ্রামে এসে দেখা করেন দেড় বছর আগেই। সেখানেই এই গোটা ঘটনার ব্লু প্রিন্ট তৈরি হয়৷ চারজনকে আশ্রয় দেন বিশাল ও ললিত।
দিল্লি পুলিশ তদন্তে দেখে ১৮ মাস আগে মাইসুরুতে তাদের প্রথম মিটিং হয়েছিল। সেই মিটিংয়ে বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি, মণিপুরের হিংসা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। ৯মাস আগে অপর একটি মিটিং হয়েছিল। চন্ডীগড় বিমানবন্দরের কাছে সেই মিটিং হয়। এরপর মনোরঞ্জন সংসদ ভবনের কাছে এসে গোটা ব্যাপারটা খতিয়ে দেখেন। সেই সময় তারা বুঝতে পারেন সংসদে দেহ তল্লাশির সময় জুতো দেখা হয় না। সেই মতো তারা পরিকল্পনা করেন। যাতে জুতোর মধ্যে স্মোক ক্যান লুকানো যায়। এরপর একাধিকবার তারা রেইকি করেছিলেন।
এরপর সংসদ হামলার দিনটা তারা বেছে নেন। রবিবার চারজন দিল্লি আসেন। ভিকির বাড়িতে তারা ছিলেন। লাতুর থেকে এই স্মোকক্যান আনা হয়েছিল। ইন্ডিয়া গেটের সামনে আধ ঘণ্টা আলোচনা করে তারা সংসদের কাছে আসেন। এদিকে ঠিক যেভাবে ভগৎ সিং ১৯২৯ সালে করেছিলেন সেভাবেই তারা প্রতিবাদ প্রদর্শন করে লিফলেট ছড়াবেন বলে ভেবেছিলেন। দিল্লি থেকে জাতীয় পতাকাও কিনে এনেছিলেন।
পুলিশ জানাচ্ছে, ভগৎ সিংয়ের ভক্ত ওই ছ’জন তাঁর থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে স্থির করেছিলেন, নিজেদের দাবিদাওয়া, মতামত কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পৌঁছে দিতে ভগৎ সিং-এর পদ্ধতি-ই অনুসরণ করবেন তাঁরা। ঠিক যেভাবে, সংসদে বোমা ফেলে, প্রায় স্বেচ্ছায় গ্রেফতার হয়ে আদালতে দাঁড়িয়ে নিজেদের কথা জানাতে চেয়েছিলেন ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্তেরা, ঠিক সেই ভাবে৷ এমনকী হলুদ রং বোমা বা স্মোক ক্র্যাকার বেছে নেওয়ার পেছনেও সেই ভগৎ সিংই রয়েছেন বলে মনে করছেন তদন্তকারীরা। কারণ ‘কেশরী’ স্বাধীনতা সংগ্রামী ভগৎ সিং-এর প্রিয় রং বলেই জানেন সকলে।