মেহেনাজ পারভিন
তামাম বিশ্বের ১০০ জন ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ব্যক্তিত্বের তালিকায় প্রফেট মুহাম্মদকে(PBUH) ১ নম্বর জায়গায় রেখেছেন ড.মাইকেল হার্ট। এই ১০০ জন ব্যক্তিত্ব এমন যারা সেই সময়কার সমাজের গতিমুখ বদলে দিয়েছিলেন। স্রোতের অভিমুখ বদলে ফেলা সহজ ব্যাপার নয়। সাধারণের প্রবণতা হল স্রোতে ভেসে যাওয়া। সেই স্রোতকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করা। আজকের প্রজন্মের ভাষায় বলতে গেলে ‘ট্রেন্ডের সহি ইস্তেমাল।’ কিন্তু মাইকেল হার্টের “The 100” এখনও বেস্ট সেলার। হজরত মুহাম্মদকে (PBUH) প্রথম স্থানে রাখলেও তিনি কিন্তু জেসাস ক্রাইস্ট অর্থাৎ যীশু খ্রিস্টকে দ্বিতীয় স্থানে রাখেননি। তিনি দ্বিতীয় স্থানে রেখেছেন আইজাক নিউটনকে। তৃতীয় স্থানে যীশু। এবং চতুর্থ স্থানে গৌতম বুদ্ধকে রেখেছেন।
মাইকেল হার্টের এই অভিমতকে ভিন ধর্মাবলম্বীরা গ্রহণ না করতেই পারেন। সেটা তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। তবে মাইকেল হার্ট ঠিক কে? তাঁর পরিচয় এখানে তুলে ধরা জরুরী। কর্নেল ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি স্নাতক হয়েছিলেন। নিউ ইয়র্ক ল’স্কুল থেকে এলএলবি করেন। আডেলফি ইউনিভার্সিটি থেকে এমএস করেন। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিএইচডি করেন। মেরিল্যান্ডে নাসার স্পেস ফ্লাইট সেন্টারে কাজ করেন। ন্যাশনাল সেন্টার ফর এটমোস্ফেরিক রিসার্চে কাজ করেন। এছাড়া বহু স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে তিনি নিজের কাজের ছাপ রেখেছেন।
খেয়াল করলে দেখবেন, “The 100” এ উল্লেখ করা এই নক্ষত্রসম মানুষগুলি প্রত্যেকে মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে এসেছেন। অর্থাৎ জুলম থেকে নূরের দিকে আহবান করেছেন। আরবিতে জলুম মানে যেমন অত্যাচার তেমন এর আর এক অর্থ অন্ধকারও। অত্যাচার তো অন্ধকারই। প্রশ্ন হল মাইকেল হার্ট কেন মুহাম্মদকে (PBUH) বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানুষের তকমা দিলেন। এর পিছনে যুক্তি কি। তিনি খ্রিস্ট ধর্মের লোক হয়েও যীশুকে তৃতীয় স্থানে রাখলেন কেন? কেবল মাইকেল হার্ট বলছেন বলে নয়,আপনি ভাবলে নিজেও বুঝতে পারবেন।
বহু মহামানব এই বিশ্বে স্বর্গীয় বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু আম আদমির জন্য সেই জীবন পালনের স্পষ্ট কোনো দিক নির্দেশনা দিয়ে যান নি। নিজের জীবৎকালে মুহাম্মদ(PBUH) তা করে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গী সাথীরা তাঁর নির্দেশিত পথে চলেছেন। তিনি যে কাজেরই নির্দেশ দিয়েছেন, সে কাজ নিজে অনুশীলন করেছেন। কেবল আদর্শের বাণী প্রচার করে ধর্মকে দর্শনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেননি। সেখানেই তিনি অনন্য। সেখানেই তিনি ব্যতিক্রমী।
আরও পড়ুন : ‘মুখর’ প্রধানমন্ত্রী হাতরাস কাণ্ডে এমন নীরব কেন, প্রশ্ন দেশ জুড়ে
আজকের দিনে নতুন করে মুস্তাফার (PBUH) কথা আলোচনার প্রেক্ষিত হল, বিশ্ব মানবতার বাস্তব বার্তাবাহকের জন্যদিন । অর্থাৎ ১২ রবিউল আউয়াল। জন্মদিন নিয়ে বাড়াবাড়ি কিংবা আপ্লুত হবার প্রচলন তখন ছিল না। ফলে নবীর জীবদ্দশায় তাঁর জন্মদিন নিয়ে আলাদা করে হইহুল্লোড় হয়েছে, এমন নথি নেই। তবে আজকাল সব ধর্মের মধ্যেই আধ্যাত্মিকতা বর্জিত মোটা দাগের ধমীয় অনুষ্ঠান জায়গা করে নিয়েছে। ইসলামও তার বাইরে নেই। এই নবী দিবসে বাইকে পতাকা লাগিয়ে হেলমেট ছাড়া বহু মুসলিম যুবককে আমোদ করতে দেখবেন । ভিন ধর্মে এমন আমোদ বহু দিন ধরেই ছিল। ইসলামে তার অনুপ্রবেশের দাম দিতে হচ্ছে মুসলিমদেরই। ইসলামের প্রতি যাদের শ্রদ্ধা রয়েছে তাঁরা এমন রঙ্গ-তামাশা দেখে কষ্ট পান। কিন্তু করারই বা কি আছে। আমোদ ছাড়া আজ আর কিছুই হয় না। ব্যাবসায়ী থেকে রাজনীতিবিদ, সকলে আমাদে উৎসাহ দেয়। নৈতিকতা ও প্ৰকৃত ধর্মে নয়।
ইসলাম একটা জীবন বোধ। একটা বাস্তবতা । কিভাবে একজন মানুষ এই দুনিয়াতে সুস্থ দেহে ও মনে জীবন কাটাতে পারে তার রূপরেখা। তা মুসলিমরা পেয়েছেন মুহাম্মদের (PBUH) কাছ থেকে। ধনীর জীবন কেমন হবে, নির্ধনের জীবন কেমন হওয়া উচিত। সাংসারিক জীবন কেমন হওয়া উচিত। রাষ্ট্রিয় ও সামাজিক জীবন কেমন হওয়া উচিত, সে জীবন যাপন করে তিনি আমাদের দেখিয়ে গিয়েছেন। দূর থেকে পথে আলো ফেলে নয়। সঙ্গে সঙ্গে পথ হেঁটেছেন তিনি। ভদ্রতা , বিনয় যেমন তিনি দেখিয়েছেন, তেমনই অপছন্দ করেছেন কাপুরুষতা। ধনীর অপব্যায়ে যেমন আপত্তি করেছেন, তেমনই কার্পণ্য থেকে সকলকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর বাণী, তাঁর যাপিত জীবন বোধ, বিশ্ববাসীর জীবনের মূলধন হওয়া উচিত ছিল। তিনি কেবল মুসলমানের জন্য নয়। তিনি এসেছিলেন এই বিশ্বের পথপ্রদর্শক হিসাবে।
মুশকিল হল তাঁর বাণী কিছু মানুষের স্বার্থে আঘাত করে সজোরে। সুদখোর কি তাঁর ওপর খুশি হবে? মদখোর কি তাঁর জীবনবোধকে আদর্শ বলে ধরে নেবে ? সংসার থেকে পালিয়ে, নিজের দায়িত্ব কর্তব্য থেকে সরে ,কেবল ঈশ্বরের আরাধনার কথা বলে পালিয়ে বেড়ানোকে তিনি পবিত্র কর্তব্য মনে করতেন না। তাই ইসলামে আলাদা করে সন্ন্যাসের গুরুত্ব নেই। এটাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখা হয়েছে। তিনি দানে উৎসাহ দিয়েছেন। ক্ষমা করার ওপর জোর দিয়েছেন। বাধ্যতামূলক দান ইসলাম ছাড়া আর কোনও ধর্মে নেই। নিরাকার পরম করুনাময়ের শরিক করতে তিনি নিষেধ করেছেন। তাহলে বলুন না, এতে মুনাফাখোরদের সমস্যা হওয়ার কথা নয় কী?
যারা উত্তরাধিকার সূত্রে মুসলিম কিংবা যারা কেবল কণ্ঠে মুসলিম তারাও নবীর দেখানো পথে কম্ফোর্টেবল নন, তাহলে অন্যদের কথা বলে আর লাভ কি! আহম্মদ মোস্তফা মুহাম্মদ মুস্তাফা(PBUH) যে সময় অজ্ঞতা দূর করতে আলো হাতে এসেছিলেন এসেছিলেন, সেই জাহেলিয়াত (অজ্ঞতা ) আজও আছে। বরং সেই জাহেলিয়াতকে স্পন্সর করার লোকের সংখ্যা বাড়ছে। অজ্ঞতা কেন্দ্রিক ব্যবসার বাড়বাড়ন্ত সবথেকে বেশি। অজ্ঞতার যুগ বলে যে সময়টাকে ইসলামী ইতিহাসে চিহ্নিত করা হয়, তা সাহিত্যে, গানে, জাদুবিদ্যায়, নগ্ন চিত্রপ্রদর্শনে, মূর্তি নির্মাণে যথেষ্ট খ্যাতি পেয়েছিল। কিন্তু সাধারণ মনুষ্যত্ব থেকে তার দূরত্ব ছিল আলোকবর্য প্রমাণ। কন্যা সন্তান হত্যা ছিল সাধারণ ব্যাপার। ব্যাভিচার ছিল সাধারণ ঘটনা। । দাসের জীবন ছিল পশুর সমান। সুদ ছিল। জুয়ো ছিল। মদ ছিল। প্রমোদ ছিল। সবই ছিল ধনীদের জন্য। গরিবের জন্য কেবল জুলুম। সেসব থেকে মানুষকে মনুষত্বের পথে এনেছিলেন নবী। নির্মাণ করছিলেন মানুষের জীবন কাঠামো। যাতে কেবল মুসলিম নন উপকৃত হবে গোটা বিশ্ব। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ।
তিনি মক্কা-জুড়ে ইসলামী জীবনের যে সৌম রূপ প্রদর্শন করেছিলেন তা বিশ্বের কাছে ছিল অজানা। নবীর সাহাবীরা(সাথীরা) অনেকেই সেই ধারা বজায় রেখেছিলেন। হজরত মুহাম্মদের কোনও স্ট্যান্ডিং আর্মি ছিল না। কিন্তু তাঁর নির্দেশে সকলেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যেত। খেজুর গাছের ছায়ায় তিনি আরামে ঘুমিয়ে পড়তেন। নিশ্চিন্ত মনে। নিরাপত্তারক্ষীর প্রয়োজন পড়ত না। তাই আজকের দিনে তার জীবন চরিত আমাদের সম্বল হওয়া উচিত নয় কী ? তাঁর আদেশ ও নিষেধ বিশ্বকে ত্রাণ করতে পারে । যারা তা মেনে চলবে তারা শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠতে পারে। শাসককে প্রশ্ন করতে পারে । জুলুমের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে পারে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে।
নিরপেক্ষভাবে মানবতার দাবিতে ইতিহাস চর্চা করলে বুঝতে পারবেন, হজরত মুহাম্মদের(PBUH) মত এমন করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি কেউই। গর্জে উঠেছেন অনেকেই। কিন্তু শোষণ ও দুর্নীতি বর্জিত সমাজ কেমন হওয়া উচিত,তা দেখাতে পারেননি। অনেকেই উপদেশ দিয়েছেন, কিন্তু এমন জীবন রেখে যাননি যা অনুশীলন করা যেতে পারে। সে কারণে হজরত মুহাম্মদের জন্মদিন নিয়ে অনেকেই আবেগঘন হন। ভালোবাসা , শ্রদ্ধা , প্রেম তো আবেগেরই প্রকাশ। তাতে ক্ষতি নেই। তবে তাতে বাড়াবাড়ি যেন না হয়। যে জীবন যাপন তিনি আপত্তি করেছেন, তাকে যেন আমরা ভয় করতে শিখি। তাতে কেবল মুসলিমের কল্যাণ নয়, তাতে সকলের কল্যাণ। সে কারণেই তিনি বিশ্বের রহমত স্বরূপ। তাঁর আগমন দিবসে আমাদের চর্চার বিষয় হোক সেটাই। আর সেটা করতে হবে অত্যন্ত শালীনভাবে। মাইকে চিৎকার করে নয়। রাসুল্লাহ চিৎকার করে কথা বলা পছন্দ করতেন না। দুঃখের বিষয় আমাদের উলামারা অনেকেই চিৎকরে করে ছাড়া মাইকে কথায় বলতে পারেন না।
আরও পড়ুন : নেতা কিংবা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে ধর্ম খুঁজছেন ? সেটা আপনার মূর্খামি