মনীষা ঘটক
সব পাখি মাছ খায়, দোষ হয় মাছরাঙার। কথাটি বাদশা ও রতন কাহারের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক। ক’জন আছেন বুক ঠুকে বলুন তো আপনারা ‘বড়লোকের বেটি লো’ গানটি যে রতন কাহারের লেখা তা জানতেন? আপনাদের ফেসবুকের দিব্যি! যদি মিথ্যা বলেন, তাহলে আপনাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট যেন ব্লক হয়ে যায়! হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট -এ যেন বাজ পরে! আপনার ৪ জি মোবাইল যেন ২ জির মত কাজ করে!
আরও পড়ুন: মোমের আলোয় উদ্ভাসিত ভারত! ‘ভুয়ো’ ছবি পোস্ট করে ফের ট্রোল হলেন অমিতাভ
দু’চারজন সোশ্যাল সাইটে বাদশার পিছনে লেগেছে দেখে বাকিরা আহ্লাদে সাড়ে ৮ খানা। লকডাউনের বাজারে বাদশার পিছনে লাগার মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইছে না আহাম্মকের দল। বাদশা বেচারি বহু জনের মতই কেসটা জানতেন না। এই গান আসলে রতন কাহারের জানার পর থেকে ভদ্রলোকের মত রতন কাহারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বাদশা ওরফে আদিত্য প্রকাশ সিং সিসোদিয়া । ক্ষমাও চেয়েছেন। রতন কাহারের অ্যাকাউনটে ৫ লক্ষ টাকাও পাঠিয়েওছেন। লকডাউন কাটলে দেখা করার কথাও বলেছেন। কলিকালে একজন ভদ্রলোকের কাছ থেকে এর থেকে আর বেশি কীই বা আশা করা যায়? নেটবাসীদের পিনিক কত ! সবাই যেন নীতিবাগীশ গৌতম বুদ্ধ। রতন কাহারের কথা ভেবে রাতে ওদের ভালো ঘুম হয় না। যত সব ফ্রাসটু লোকজন।
আচ্ছা ভাই বলুন তো ক্রিয়েটিভ লোকেরা কে টোকেনা? কনসেপ্ট মানুষ, মানুষের কাছ থেকে নেয়। অনেক সময় তা মূল বিষয়টির থেকে ভালও হতে পারে। খারাপ হতে পারে। বলিউডের ছবির দিকেই তাকান না, কত যে টোকা তা গুনে শেষ করতে পারবেন না। আপনি জানেন না তাই আপনার কাছে নতুন। নাটক, কবিতা, গান মানুষ একজন আরেকজনের কাছ থেকে নেয়। একটির আলোকে অন্য জিনিস তৈরী হয়। অবশ্যই ভদ্রলোকের উচিত উত্তরাধিকার হিসাবে পাওয়া এই ঋণ স্বীকার করা। বাদশা এগুলি করেছেন। তারপরও তাঁকে নিয়ে খিল্লি যেন থামছেই না।
আরও পড়ুন: করোনার অন্ধকার দূর করতে একজোট বলিউড, অক্ষয়ের উদ্যোগে প্রকাশ্যে ‘মুসকুরায়েগা ইন্ডিয়া’
তবে হ্যাঁ সত্যি কথা বলতে কি, জ্যাকলিনের কারণেই লোকে গানটা এতবার দেখছে। এতেই বা বাদশার দোষ কোথায় ? মানুষ সুন্দরীদের দেখে। পুলকিত হয়। তাছাড়া আজকাল গান মানুষ শোনে কম, দেখে বেশি। জ্যাকলিনকে এলো শাড়িতে মানিয়েছে মারাত্মক। তার শরীরী ভাষা কম উদ্দীপক নয়। সেখানে বাদশা অবশ্য ভূতে পাওয়ার মত কিসব কপচেছে। আজকাল গানের মধ্যে এমন কিছু ভূতে পাওয়া টাইপ কথা তো চলে। তাতে এত দোষেরই বা কি আছে?
বাদশার কথাগুলির সঙ্গে বড় লোকের বেটি লো এই ফোকটির যোগ ঠিক কোনখানে তা অবশ্য আমি বুঝতে পারিনি।তা হোক। এমন তো বহু কিছুই হয়। বহু আর্ট ফিল্ম দর্শকদের মাথার ওপর দিয়ে গিয়ে দেওয়ালে দাগ কাটে। সেগুলি সব ইনটেকচুয়াল মার্কা তখন দর্শক নিজেকে চার অক্ষরের বোকা ভেবে সবকিছু চেপে যায়। এখন যত পুড়কিবাজি বাদশাদের মত গায়কদের নিয়ে। যারা অন্যের ইউটিউব কন্টেন্ট ঝেড়ে চ্যানেল চালায় তারাও অনেকে বলেছেন বাদশা ঠিক করেননি। এদের বগলে টিকে দাদ হোক! চুলকোবে আর মজা পাবে। তাহলে অন্যের পিছনে লাগতে আসবে না।
নিউজপেপারের অফিসে এরকম ক্যাল মার্কা কিছু লোক ফোন করে ভুল শুধরে দেয়। সামান্য ছাপার ভুল বুঝতে পেরেও শুধরে দেওয়ার কি পিনিক। তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলতে হয়, ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। এদের আর তখন দেখে কে। হেবি পুলক। যারা বলছে গানটা বোগাস তারা স্বপ্না চক্রবর্তীর গানটা বোধহয় এতবার শোনেনি, যতবার বাদশা ও জ্যাকলিনকে দেখেছে।
আরও পড়ুন: Super Pink Moon 2020- দেখুন সেরা ছবি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে
সম্ভবত ওদের রাগের কারণটা মনস্তাত্ত্বিক । জ্যাকলিনের ওই মাখন শরীরে বলিউডি নায়করা গিটার বাজালে এরা এত রাগত না । ওরা নায়ক, ওরা যা খুশি করুক। তা বলে তুই এরকম করবি কেন। তুই গায়ক, গায়কের মত থাকবি। ব্যাটা অপসংস্কৃতি! আমাদের ঘরের গান নিয়ে মজা মারা। আমরা এমনিতেই বিদ্রোহী টাইপ। আমরা ছেড়ে দেব ভেবেছ? দরকার হলে আমরা সোশ্যাল সাইটে সার্জিকাল স্ট্রাইক করব।
আসলে নেটিজেনরা অনেকেই জানেন না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লালন থেকে কিছু গানের শব্দ ও ভাব নিয়েছেন। বাংলার কীর্তন থেকে শব্দ নিয়েছেন। তবে তাঁর চেতনা ও ভাষা আরও পরিশীলিত ও পরিমার্জিত হয়েছে। ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ গানটার কথাই ধরুন না। গানটিকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে গিয়েছেন কবিগুরু। এই গানটির আসল ছিল ‘হরিনাম দিয়ে জগত মাতালে আমার একলা নিতাই’। সেই সুর বজায় রেখে ঠাকুর লিখলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে।’ গানটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে। রবীন্দ্র গানে লালনের যেমন প্রভাব রয়েছে, তেমন গগন হরকরার গানেরও প্রভাব রয়েছে। তাঁর বহু কবিতায় রয়েছে হাফিজের ছায়া। কিন্তু আপন চেতনা ও শব্দ দিয়ে তিনি তা অসাধারণ করে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রবাসী পত্রে লালন ফকির এবং গগন হরকরার গান প্রকাশ করেছিলেন। গগন লিখেছিলেন,’আমি কোথায় পাবো তারে।’ রবীন্দ্রনাথ সেই সুরে লিখলেন,’ আমার সোনার বাঙলা’।
আরও পড়ুন: জ্বলছে অরণ্য! এবার ভয়াবহ আগুনের গ্রাসে বাঁকুড়ার শুশুনিয়া জঙ্গল
রবীন্দ্রনাথের বহু লেখায় স্পষ্ট হাফিজের প্রভাব রয়েছে। তাঁর গান ও কবিতায় যে আধ্যাত্মিক আকুলতা তা হাফিজের কবিতায় ছিল। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথের বাবা হাফিজের কবিতার সবথেকে বড় ভক্ত ছিলেন। বিশ্বকবি তাঁর লেখায় হাফিজের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেননি। মিল্টন যে ভাবে শয়তানকে জিতিয়ে ছিলেন, সেই কায়দাতেই মেঘনাথকে হিরো বানিয়েছিলেন মাইকেল। কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল , ঊর্ধ্বে গগনে বাজে মাদল’ কবিতাটিও হাফিজের থেকে নেওয়া। তাই সুযোগ পেলেই না জেনে বুঝে কাউকে নিয়ে খিল্লি করে নিজেদের নির্বোধ প্রমাণ নাই বা করলেন। সরব হোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, হোক প্রতিবাদ, গান পছন্দ না হলে শুনবেন না। কিন্তু তার আগে যুক্তিটা একটু সাজিয়ে নিন!
(মতামত ব্যক্তিগত)