সৈয়দ আলি মাসুদ
চিকিৎসকরাও অদ্ভুত মৌলবাদীতায় ভোগেন। নিজেদের কথা ছাড়া অন্যের কথা শুনতে চান না। এলোপ্যাথি চিকিৎসকরা হোমিওপ্যাথ বিষয়ে শুনতে মোটেও আগ্রহী নন। বরং একটা নাক সিটকান ভাব দেখা যায় তাঁদের চোখে-মুখে। যেন সবটাই বুজরুগী। ওটা চিকিৎসা নয়। হোমিওপ্যাথ চিকিৎসকরাও মনে করেন এলোপ্যাথি আসলে এমন চিকিৎসা পদ্ধতি, যাতে রুগীর উপকারের চাইতে ক্ষতির সম্ভবনা বেশি। অন্যদিকে আয়ুর্বেদ, কবিরাজি এবং ইউনানি চিকিৎসকরা মনে করেন, রোগের প্রকৃত চিকিৎসা রয়েছে তাদের কাছে। গাছ-গাছড়া মানুষের আসল ওষুধ। তা প্রাকৃতিক। তাতে ক্ষতির সম্ভবনা নেই। যদি উপকার নাও হয়, তাতে ক্ষতি হবে না। কিন্তু এলোপ্যাথি ওষুধের পার্শপ্রতিক্রিয়া মারাত্মক।তার মূল আধার কেমিক্যাল। যা মারাত্মক।
বর্তমান এলোপ্যাথি চিকিৎসার বাড়বাড়ন্তের মূলে রয়েছে টেকনোলজি। এই চিকিৎসা আজকের দিনে বেশিরভাগটাই মেশিন কেন্দ্রিক। ফলে টেকনোলজির আপগ্রেডেশনের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকরা তাতে বাড়তি কিছু সুবিধা পাচ্ছেন। চাইলে কবিরাজ কিংবা ইউনানী চিকৎসও সেই সুবিধা নিতে পারেন। কিন্তু সুবিধা নিতে গিয়ে আজকের দিনে গোটা এলোপ্যাথি ব্যবস্থাটাই টেকনোলজিতে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে বাসা বেঁধেছে দুর্নীতি। কমিশন পেতে অযথা পরীক্ষার সংখ্যা বেড়েছে।
আরও পড়ুন : ধেয়ে আসছে দুর্যোগ, প্রবল বৃষ্টিতে ভাসতে পারে বাংলা, জারি কমলা সতর্কতা
একথা অস্বীকারের কোনও উপায় নেই যে সবথেকে বেশি দুর্নীতি এই এলোপ্যাথি চিকিৎসা চক্রেই। হোমিওপ্যাথি কিংবা কবিরাজি অথবা ইউনানীতে তেমনটা নেই । পাপাচারী ব্যাবসার লোভে দানবীয় সব ওষুধ কোম্পানি তৈরি হয়েছে। এগুলির বেশিরভাগের ঠিকানা মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র। তারা চিকিৎসকদের দিয়ে ওষুধ গছিয়ে দেয়। তাতে চিকিৎসকদের বাড়তি মুনাফা থাকে। তাদের সামনে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পনি গুলি সব সময় গাজর ঝুলিয়ে রাখে। ‘বেশি ওষুধ লেখো, বেশি টেস্ট করাও , আর বাড়তি কামাও।’ এই করতে গিয়ে বিশ্ব জুড়ে অগণিত মানুষের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু সেসব পরোয়া করেন না বেশিরভাগ এলোপ্যাথি চিকিৎসক। তারা এই চিকিৎসা ব্যবস্থা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারে না। বাকি চিকিৎসাকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন। সেটাই মৌলবাদিতা।
ইউনানী এবং আয়ুর্বেদ চিকিসকরা নানা বড় বড় কথা বললেও সময়ের সঙ্গে নিজের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো সদিচ্ছা এই চিকিৎসা পরিমন্ডলে দেখা যায় না। আমাদের দেশর সরকার একটু চেষ্টা করলে এই চিকিসা ক্ষেত্রগুলিকে এগিয়ে নিয়ে আসতে পারত। আসলে এক্ষেত্রে আম আদমির ভূমিকাও কম নেই। আয়ুর্বেদ এবং ইউনানী চিকিৎসা মূলত প্রাকৃতিক উপাদানের উপর ভিত্তি করে তৈরী। কেমিক্যালের মত তাৎক্ষণিক কাজ এতে হয় না সংগত কারণে।
আমাদের শরীর কেমিক্যাল চেনে না। আল্লাহ, ঈশ্বর , কিংবা প্রকৃতি কেমিক্যাল চেনার উপযুক্ত করে আমাদের শরীরকে বানায়নি। তাই অপরিচিত কেমিক্যাল আমাদের পাকস্থলীতে যাবার পরই, পাকস্থলী তা লিভারে পাঠিয়ে দেয়। ফলে প্রতিদিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লিভার। এটা ইউনানী কিবা কবিরাজি ওষুধে হয় না। কারণ মানব শরীর এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্যবহার করা প্রাকৃতিক গুণসম্পন্ন ওষুধগুলি চেনে। সে কারণেই তার এমন ক্ষতিকর সাইড ইফেক্ট মানুষের ক্ষতি করে না।
ভাবছেন তাহলে মানুষ এমন প্রাকৃতিক ওষুধ কেন গ্রহণ করছে না। মুদির দোকানদার আপনাকে পলিথিন না দিলে আপনি সেই দোকানে যেতে চান না। কিন্তু নিজেও জানেন পলিথিন খুবই ক্ষতিকর। কিন্তু কাগজের প্যাকেট দিলে আমরাই সব থেকে রাগ করি। আমাদের এই তাৎক্ষণিক ভালো চাওয়ার আকাঙ্খায় মুনাফালোভী ব্যাবসাদারদের উৎসাহিত করেছে বিশ্বজুড়ে।
আমরা যে এলাকার মানুষ, সেখানকার আবহাওয়া, জীবন চরিত অনুযায়ী আমাদের অসুখ বিসুখ হয় । প্রকৃতি যেহেতু অত্যন্ত যুক্তিবাদী তাই এর ওষুধ সে আমাদের এলাকাতেই রাখে। এটাই নিয়ম। কিন্তু আমরা সেখানে তা খুঁজছি না। আমার অসুখের ওষুধ আসছে মার্কিন মুলুক কিংবা চীন থেকে। এবং সেই ওষুধকেই সর্বকল্যাণকর বলে চালানো হচ্ছে। গোল বাধছে সেখানেই।প্রাকৃতিক উপাদানের জায়গা ঠাঁই নিচ্ছে কেমিক্যাল।
এলোপ্যাথি , হোমিওপ্যাথি , কবিরাজি এবং ইউনানি চিকিৎসকরা ঠিক রাজনৈতিক দলের লোকেদের মত পৃথক অবস্থান নিয়ে চলছেন। একজনের প্রতি অন্যজনের চোখে অবজ্ঞা ও উদাসীনতা। অথচ এমন বহু রোগী রয়েছেন এলোপ্যাথি চিকিৎসকরা যাদের খরচের খাতায় ছেড়ে দিয়েছে। তারা হোমিওপ্যাথ করে দিব্যি ভালো রয়েছেন। কেউ কেউ নামি দামি হাসপাতালে লাখ-লাখ টাকা খরচ করে বিফল হয়ে ইউনানি-কবিরাজি চিকিৎসায় সেরেছেন।
আজকের দিনে অত্যন্ত জরুরী হল মৌলবাদিতা ছেড়ে, উন্নাসিকতা ছেড়ে চিকিৎসা ক্ষেত্রে পরস্পরের ভালটা গ্রহণ করা। আমি এলোপ্যাথি চিকিসক তাই আমি ‘সুপিরিয়র’ এই মানুসিকতা ছাড়তে হবে। একই সঙ্গে এলোপ্যাথি সব ওষুধে সাইডে ইফেক্ট , তাই তা বাতিল-এই মানসিকতাও ছাড়তে হবে। মনে রাখবেন, আপৎকালীন পরিষেবায় এলোপ্যাথির কোনো বিকল্প নেই। কারও ব্রেইনে রক্তক্ষরণ হলে তৎক্ষণাৎ এলোপ্যাথির আশ্রয় নিতে হবে। কারও হৃদযন্ত্রে ব্লকেজ। অবশ্যই এলোপ্যাথি চিকিসা লাগবে। কিন্তু সবেতেই তা জরুরি নয়। কারণ এই ওষুধের সাইডে ইফেক্ট মারাত্মক। সেক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি, কবিরাজি কিংবা ইউনানী ওষুধ সেবন করাই ভালো।
এমনিতেই আমরা ধর্ম , জাত, সংস্কৃতি নিয়ে বিভাজিত। পরস্পরকে খাটো দেখানোটা আমরা নিজেদের দায়িত্ব মনে করি। তা নাহলে যেন নিজের উচ্চতা বাড়ে না। এসবের মাঝে চিকিসকরাও যদি এমনটা করেন, তাহলে সত্যিই বিপদ। চিকিৎসকরা নিজেদের ‘কুলিনপনা’ ছাড়লে উপকৃত হবেন বিশ্ব মানব। তাই একটু ভেবে দেখবেন।
অভিমত ব্যাক্তিগত
আরও পড়ুন : করোনার প্রকোপ কমতে অন্তত দু’বছর সময় লাগবে, আশংকা বাড়িয়ে মন্তব্য WHO প্রধানের